সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

স্বাধীনতার আগের ও পরের শাসনের পার্থক্য

১৯৪৭ সালের আগে প্রায় ২০০ বছর দেশ শাসন করেছে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। কোম্পানির বোর্ড অফ ডিরেক্টররা সরাসরি এই শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত থাকত না। তারা তাদের সমর্থক রাজনিতিকদের দেশ শাসনের দায়িত্বে বসাতেন। তাদের দিয়েই কোম্পানি ভারত সহ অন্যান্য উপনিবেশগুলোর নীতি নির্ধারণ ও তার প্রয়োগ ঘটাতেন।

বলা বাহুল্য, এই নীতি নির্ধারণ ও প্রয়োগের মূল উদ্দ্যেশ্য ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক লাভ। ভারতীয় অর্থনিতির সঙ্গে সম্পর্কিত সব ক্ষেত্র যেমন শিল্প নীতি, কৃষি নীতি, বাণিজ্য নীতি - সবই নির্ধারিত ও পরিচালিত হত ইস্ট ইন্ডিয়ার কোম্পানির স্বার্থকে সামনে রেখে।

ভুরিভুরি উদাহরণ রয়েছে কোম্পানির সঙ্গে তৎকালীন ভারত সরকারের এই অশুভ আঁতাতের। মাত্র দুটো উদাহরণ দেখুন। 
১৮৩২ সালে ভারতে রেলপথ স্থাপনের প্রস্তাব ওঠে। কেন? ব্রিটিশ পুঁজির বিনিয়োগের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা এবং বিদ্রোহ দমন সহ অন্যান্য সামরিক প্রয়োজন মেটানো। ভারতের সাধারণ মানুষের ভালোমন্দের বিষয় এখানে একরত্তিও গুরুত্ব পায়নি।

ইচ্ছা করলেই রেলপথ নির্মাণের দায়িত্ব সরকার নিতে পারত। কিন্তু নেয় নি। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের পুঁজিপতিদের চাপে এই দায়িত্ব বেসরকারি কোম্পানির হাতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। প্রস্তাব আসে গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিন্সুলার রেল কোম্পানির নামে। সিদ্ধান্ত হওয়ার পর প্রশ্ন তোলা হয় ভারতে রেলপথ নির্মাণ যে লাভজনক হবে তার গ্যারান্টি কোথায়? কোন শর্তে তারা পুঁজি বিনিয়োগ করবে?

ভারতীয় জনগণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ট্যাক্সের টাকায় চালু হল গ্যারান্টি ব্যবস্থা। শর্তগুলো দেখুন - 
১) সরকার বিনামুল্যে জমি দেবে। মানে, ভুমিপুত্ররা জমি হারাবে।
২) কোম্পানির বিনিয়োগ করা মূলধনের ওপর সরকার ৫ শতাংশ হারে সুদ দেবে কোম্পানিকে।
৩) এর পরও যদি লাভ না হয় ভারত সরকার কোম্পানিকে ক্ষতিপূরণ দেবে। 

মজার কথা হল, ভারতীয়দের শোষণের আরও একটা উপায় বের করে দেওয়া হল এই তিন নম্বর শর্তে। লাভের গ্যারান্টি থাকায় রেল কোম্পানিগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে খরচ বাড়িয়ে দেখিয়ে যথেচ্ছভাবে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে থাকে।

ভারতীয়রা প্রতিবাদ করলেন। বাধ্য হয়ে সাময়িক পিছু হটলো ব্রিটিশ সরকার। রেলপথ নির্মাণের দায়িত্ব নিজ হাতে নিল। ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো এটা মানতে পারেনি। না পারাই স্বাভাবিক। নিশ্চিত মুনাফালাভের এমন দরজা যদি বন্ধ হয়, মাথা কীভাবে ঠিক রাখা যায়? ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ঝড় উঠল। সরকারি উদ্যোগে রেলপথ নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। সখা বললে, সখি কীভাবে ফেলবে কথা। স্বাভাবিকভাবেই কোম্পানির চাপে সরকার রেলপথ নির্মাণের দায়িত্ব কোম্পানির হাতেই তুলে দিল।

অন্যদিকে ভুমিপুত্ররা জমি হারালো। অথচ ক্ষতিপূরণ নেই, তাদের মতামত দেওয়ার প্রশ্নই নেই। কারণ, দেশকে ভালোবেসে আত্মত্যাগ করতে হবে। না করতে চাইলে তুমি দেশদ্রোহী। সিধু-কানু-বিরসা মুন্ডা  দেশদ্রোহী হল। খেয়াল করুন আজও 'সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে'। যারা হুড়োহুড়ি করে সিধু-কানু-বিরসাদের গলায় মালা পরাচ্ছেন, শহিদের মর্যাদা দিচ্ছেন, তারাই ঠিক কোম্পানির শাসকদের মত ভুমিপুত্রদের জমি কেড়ে দেশিও কোম্পানিকে কখনও বিনামুল্যে আবার কখনও নামে মাত্র দামে জমি দিচ্ছে। প্রতিবাদ করলে হয় দেশদ্রোহীর খেতাব নয় পুলিশের গুলি। যারা সমর্থন করবেন তারা আর্বান নকশাল খেতাব নিয়ে জেলে।

আমরা এমনই হতভাগা, তখন যেমন আমাদের পুর্বপুরুষদের বড় অংশের সাধারণ মানুষ ব্রিটিশ সরকারের দ্বারা কোম্পানির সুবিধা করে দেওয়া এবং তার ফলে নিজেদের এই সর্বাশের কথা বুঝতে পারেনি, তেমনি এখনও তাদের উত্তরসূরি্নিও তা বুঝতে পারছেন না। পারবেন কী করে? তারা তো পড়াশোনা করতে চান না। আর ইতিহাসে তো এদের এলার্জি। আবার যারা পড়েন, তারা শুধু নোট মুখুস্থ করেন পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করার জন্য। ফলে, ইতিহাসবোধ তৈরি হয় না। কারণ, ইতিহাস পাঠের মূল উদ্দেশ্যই তো তারা জানেন না, তাই সেভাবে পড়েন না, বোঝেনও না।



দাদাভাই নৌরজি দেখিয়েছেন

তাদের সহযোগিতা করেছিল এ দেশের জমিদার মহাজনসহ উচ্চবর্গের ( আপনি পড়ুন উচ্চবর্ণের) ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি।

আর এখন স্বাধীন ভারতের শাসন পরিচালনা করছে মূলত এবং প্রধানত ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান কোম্পানি। এদের সহযোগিতা করছে একটি পুঁজিবাদী রাজনৈতিক দল, যাদের পরোক্ষভাবে নিয়োগ ও প্রত্যক্ষভাবে অর্থের যোগান দেয় এই সব ইন্ডিয়ান কোম্পানিগুলো। বর্তমান সরকারের পিছনে গুজরাটকেন্দ্রিক পশ্চিম ভারতীয় কোম্পানিগুলোর আগ্রাসী ভূমিকা রয়েছে।

সাধারণ মানুষ জানেন না, এরাই (এদের পূর্বপুরুষরা) ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশদের দালালি করেছে। কখনো জমিদার হিসাবে, কখনো মহাজন হিসাবে এবং কখনো ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ব্রিটিশ সরকারের চাকরিজীবী হিসাবে।

ব্রিটিশ সরকার এদেরকে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার নাম করে মূলত কেরানি তৈরি করার পাঠক্রম তৈরি করেছিল। কারণ, সাম্রাজ্যবাদী শাসক হিসেবে এ দেশে তাদের শাসন ও শোষণকে কায়েম ও মজবুত রাখার জন্য শুধুমাত্র ‘মাছিমারা কেরানি’ই দরকার ছিল।

Difference-between-pre-independence-and post-independence-regimes
Difference between pre-independence and post-independence regimes

মন্তব্যসমূহ

আলী হোসেনের বহুল-পঠিত উক্তিগুলো পড়ুন

ধর্মের নামে রাজনীতিই প্রমাণ করে আমরা মধ্যযুগীয়

ধর্মের নামে রাজনীতিই প্রমাণ করে আমরা মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষে এখনও যে ধর্মের নামে রাজনীতি হয় বা হচ্ছে, তাতেই প্রমাণ হয় আমরা আধুনিক নয়, চিন্তায়-চেতনায় এখনো মধ্যযুগে বাস করি। কারণ, আধুনিক যুগের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য আছে। কোন জাতি, নিজেকে আধুনিক বলে দাবি করতে চাইলে, এই বৈশিষ্ট্যগুলো তাদের মধ্যে থাকা প্রয়োজন। এর মধ্যে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো হল ধর্ম-মুক্ত রাজনীতি। পৃথিবীর যেখানে যেখানে রাজনীতি ধর্মমুক্ত হয়েছে, সেখানে সেখানে রাজনৈতিক হিংসা হানাহানি অনেক কমে গেছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা, যা আধুনিকতার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর দিকে তাকালেই বুঝতে পারা যায় ধর্মের সঙ্গে রাজনীতি সম্পর্কিত থাকলে কি ভয়ংকর রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়। বোঝা যায়, কীভাবে নিরবিচ্ছিন্ন অস্থিরতা ও রাজনৈতিক হিংসা এবং প্রতিহিংসার দাপটে একটা জাতি শতধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। মূলত এ কারণেই, অসংখ্য ছোট ছোট, বলা ভালো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়েছে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য। ফলে সাম্রাজ্যবাদী বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর নয়া সাম্রাজ্যবাদী নাগপাশ

ধর্ম দিয়ে ধর্মান্ধতা দূর করা যায় না।

ধর্ম দিয়ে ধর্মান্ধতা দূর করা যায় না। কারণ দুটোরই ভিত্তি হচ্ছে যুক্তিবিমুখ বিশ্বাস। তাই, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা হয়তো যায়। কিন্তু ধর্ম দিয়ে ধর্মান্ধতা দূর করা কখনই যায় না। একথা ভুলতে বসেছেন যাঁরা, তাঁরা নিজেদের প্রগতিশীল দাবি করতেই পারেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এতে প্রগতিশীলতা গতিলাভ করে না বরং গতি হারায়। --------x------- Di Ansar Ali হ্যা, পরিস্থিতি অনুযায়ী সমঝোতা করতে হয়। কিন্তু মাথায় রাখতে হয়, তাতে আমার সত্যিই কোনো লাভ হচ্ছে কিনা। এবং তার অদূর ও সুদূরপ্রসারী ফলাফল প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করাটা মোটেই যুক্তিযুক্ত নয় বলেই মনে হয়। কারণ, তাতে পরের যাত্রা হয়তো ভঙ্গ হয়, কিন্তু নিজের শরীরে ভয়ঙ্কর ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়ার দখলদারি বেড়ে যেতে পারে। আমার মনে হয়, এই হিসাবটা ঠিকঠাক না করতে পারলে পরিস্থিতি অনুকূলে আসার পরিবর্তে প্রতিকূলে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। এক্ষেত্রে 'দশচক্রে ভগবান ভুত হওয়ার' বিষয়টিও মাথায় রাখার প্রয়োজন খুব বেশি বলেই আমি মনে করি। যারা প্রগতিশীল নয়, বলে এতদিন বলে আসছি তারা যদি হঠাৎ করে প্রগতিশীল হয়ে ওঠে তবে,

বিজেপি ও আরএসএস কি আলাদা?

বিজেপি ও আরএসএস-এর রসায়ন সম্পর্কে সম্যক অবহিত আছেন, এমন মানুষদের সবাই জানেন বিজেপির সঙ্গে আরএসএস-এর গভীর সম্পর্কের কথা। এবং তাঁরা এটাও জানেন যে, আরএসএস দ্বারা বিজেপি নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। তাই এই দুই সংগঠনকে আপাতদৃষ্টিতে আলাদা মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এরা আলাদা নয়। বরং এরা একে অপরের পরিপূরক। বিস্তারিত দেখুন এখানে ক্লিক করে

সব মানুষই আসলে এক-একজন পাগল

মানুষ আসলে কী? সব মানুষই আসলে এক-একজন পাগল। কেউ কাজ পাগল, কেউ ফাঁকিবাজিতে পাগল। কেউ গান পাগল, তো কেউ জ্ঞান পাগল। কেউ বা আবার পান পাগল। কিছু না কিছু নিয়ে আমরা প্রত্যেকে পাগলের মত ছুটে বেড়াচ্ছি। থামবো কবে? প্রসঙ্গ জানতে এখানে ক্লিক করুন

বিজ্ঞান শিক্ষার পরিবর্তে ধর্মশিক্ষার প্রচলন ও তার পরিণতি

দেশের বড় বড় বিজ্ঞান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেভাবে বেদ ও পুরাণসহ ধর্মশাস্ত্র পড়ানোর ধুম লেগেছে তাতে ভারতবর্ষ খুব তাড়াতাড়ি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মত অশিক্ষার কানাগলিতে ঢুকে যাবে। এভাবে চলতে থাকলে,বলা ভালো যেতে বাধ্য হবে। শিবপুর আই আই ই এস টি তে যেভাবে বেদ ও পুরাণ ভিত্তিক কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে তাতে এই আশঙ্কা প্রকট হয়ে উঠছে। সেই সঙ্গে গোলওয়ালকরের ছবি ও বই রেখে যেভাবে বিচ্ছিন্নতা ও সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন মতাদর্শকে হাইলাইট করা হচ্ছে তাতে ভারতের ভবিষ্যত দুর্দশার রূপটি স্পস্ট হয়ে উঠছে। বিস্তারিত পড়তে এখানে ক্লিক করুন ফেসবুকে দেখুন এখানে ক্লিক করে