সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ইতিহাস কী?

ইতিহাস কী?

ইতিহাস হচ্ছে মানুষের তৃতীয় নয়ন। এই তৃতীয় নয়ন মানুষকে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ বিষয়ে সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করতে সাহায্য করে। এই পর্যবেক্ষণই জগত এবং জীবনের প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।

একজন মানুষ, জগত ও জীবন সম্পর্কে প্রকৃত সত্য যতটা উপলব্ধি করতে পারেন, তিনি ততটাই শিক্ষিত বলে বিবেচিত হন। তাই ইতিহাস জানা এবং বোঝা ছাড়া একজন মানুষ পূর্ণাঙ্গ শিক্ষিত হয়ে উঠতে পারেন না।

ইতিহাস কেন তৃতীয় নয়ন?

একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথা ধরুন। আমরা এই ঘটনাকে যখন প্রত্যক্ষ করি, তখন দেখি দুটি ভিন্ন ধর্মের মানুষ পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে সহিংস হয়ে উঠছে। আমরা খুব সহজেই এই ঘটনাকে ধর্মের সঙ্গে জুড়ে দিই এবং ধর্মকে এর কারণ হিসেবে চিহ্নিত করি। ধর্মীয় বিদ্বেষের ফল হিসেবে সেগুলোকে ব্যাখ্যা করি।

কিন্তু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ইতিহাসকে কার্যকারণ সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, এই দাঙ্গাগুলোর পিছনে ধর্মের চেয়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য খুবই শক্তিশালী ভূমিকায় রয়েছে। অর্থাৎ মূলত, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যকে চরিতার্থ করার জন্য কোন রাজনৈতিক লিডার সরাসরি কিংবা ধর্মগুরুর ছদ্মবেশে সাধারণ মানুষকে পরস্পরের বিরুদ্ধে উসকে দেয়। ধর্মকে অজুহাত হিসাবে সামনে আনা হয় এবং অচেতন কিংবা অর্ধচেতন সাধারণ মানুষ ধর্মের নামে সহজেই পরস্পরের বিরুদ্ধে সহিংস হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে কিছু মানুষ তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করার চেষ্টা করে।

এই মানুষগুলো, এই সত্য যদি একবার উপলব্ধি করতে পারে, সে কখনোই ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নিজেকে জড়াবে না। সে যদি বুঝতে পারে, ধর্মের নাম করে একশ্রেণীর রাজনীতিক অথবা ধর্ম ব্যবসায়ী তার জীবনকে বাজি রেখে নিজের আখের গোছাচ্ছেন, তবে কখনোই সে খুনোখুনির কাজে নিজেকে জড়িয়ে, নিজের জীবনকে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ঠেলে দেবেনা। এই চেতনার জন্ম দিতে আধুনিক ইতিহাস চর্চার কোন বিকল্প নেই। এখানেই ইতিহাস মানুষের তৃতীয় নয়ন হয়ে ওঠে।

আমরা একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারি, জগতের সব বিষয়ের ইতিহাস আছে। অর্থাৎ যেকোনো বিষয়কে ঠিকঠাক বুঝতে হলে আপনাকে তাদের ইতিহাসকে জানতে হবে। অর্থাৎ ইতিহাসের সাহায্য নিতে হবে। যেমন, বিজ্ঞানকে বুঝতে গেলে বিজ্ঞানের ইতিহাস জানতে ও বুঝতে হবে, তেমনি সাহিত্যকে বুঝতে গেলে সাহিত্যের ইতিহাসকে জানতে ও বুঝতে হবে। প্রত্যেকটা বিষয়ের তাই একটা ইতিহাস থাকে, যাকে পড়তেই হয়।

একমাত্র ব্যতিক্রম হল ইতিহাস নিজেই। ইতিহাসকে বুঝতে অন্য কাউকে নয়, কেবলমাত্র ইতিহাসেরই সাহায্য নিতে হয়। পড়তে হয় হিস্টোরিওগ্রাফি (Historiography)। এই কারণে আমরা বিজ্ঞানের ইতিহাস আছে বলে জানি, সাহিত্যের ইতিহাস আছে জানি। কিন্তু এর উল্টোটা জানি না। অর্থাৎ 'ইতিহাসের বিজ্ঞান' বা 'ইতিহাসের সাহিত্য' ইত্যাদি হয় বলে আমরা জানি না।

জেনে রাখা ভালো : নতুন সামাজিক ইতিহাস কী?

ইতিহাস কাকে বলে?

এখন প্রশ্ন হল, ইতিহাস কাকে বলে? এককথায় ইতিহাসকে ধরতে হলে বলতে হবে, ইতিহাস হল মানব সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের ধারাবাহিক বিবরণ; যা যুক্তি ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে গবেষণালব্ধ ও যাচাইযোগ্য। ইতিহাস কোন অতীত কাহিনির সংকলন নয়।

জেনে রাখা ভালো : মানব সভ্যতা বলতে কী বোঝ?

উল্লেখ্য, অনেকেই ইতিহাসের সংজ্ঞায় বিবরণের জায়গায় কাহিনি শব্দ ব্যবহার করেন। কিন্তু এই শব্দটি যথাযথ নয়। কারণ, ‘কাহিনি’র মধ্যে কিছু সত্য ঘটনা থাকলেও তার সাথে মিশে থাকে কল্পকথা, যা আসলে মিথ্যা অথবা মিথ। আধুনিক ইতিহাসচর্চায় মিথ্যা বা মিথ কখনই ইতিহাস বলে বিবেচিত হয় না। কেননা, ইতিহাসের মূল লক্ষ্য হল মিথ বা মিথ্যাকে সরিয়ে সত্য অনুসন্ধান করা।

ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য :

ইতিহাসের সংজ্ঞাটিকে বিশ্লেষণ করলে তার কিছু বৈশিষ্ট্য আমাদের সামনে উঠে আসে।

১) ইতিহাস মানব সভ্যতা-কেন্দ্রিক বিষয় :

অর্থাৎ ইতিহাস তৈরি করে মানুষ। মানুষ তার সৃজনশীল ও যুক্তিবাদী চিন্তা চেতনাকে কাজে লাগিয়ে এই সভ্যতার জন্ম দেয়। গড়ে তোলে সমাজ, রাষ্ট্রচিন্তা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ। যুগ যুগ ধরে মানুষ তার জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা বিধানে এই সমস্ত ব্যবস্থা গড়ে তোলে এবং প্রয়োজনে একটু একটু করে পরিবর্তন করে উন্নততর পর্যায়ে নিয়ে যায়। ইতিহাসের পরিভাষায় এই পরিবর্তনকে বলে বিবর্তন।

২) এই সভ্যতায় ক্রম বিবর্তন ঘটে :

সভ্যতার এই বিবর্তন তখনই ইতিহাস বলে বিবেচিত হয় যখন তার নির্দিষ্ট কালক্রম অনুসরণ করে। অর্থাৎ কোন সময়ে এবং কোন ঘটনার প্রেক্ষিতে পরবর্তী কোন ঘটনা সংঘটিত হয়েছে তা ক্রমানুসারে বর্ণিত হতে হয়। এই ক্রম অনুসরণ না করলে ঘটনার মধ্যে যে কার্যকারণ সম্পর্ক থাকে তা প্রতিষ্ঠিত হয় না। এবং এই কার্যকারণ সম্পর্কহীন কোন ঘটনাই বাস্তব বলে গৃহীত হয় না। কারণ, পৃথিবীতে যা কিছু ঘটে তা এই কার্যকারণ সম্পর্কের উপর ভিত্তি করেই সংঘটিত হয়। তাই কোন ঘটনার পিছনে কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয় করতে না পারলে তার সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় না। এবং সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত না হওয়া গেলে তা ইতিহাস বলে স্বীকৃতি লাভ করে না। সভ্যতার বিবর্তন কে অবশ্যই ক্রম অনুসরণ করে এগোতে হয়।

৩) এবং এই বিবর্তন ধারাবাহিকভাবে বর্নিত হয় :

এখন এই কালামুক্রম অনুসরণ করে সভ্যতার অগ্রগতিকে উপস্থাপন করলেই তা ইতিহাস বলে বিবেচিত হয় না। ইতিহাস বলে বিবেচিত হতে গেলে ঘটনাক্রমকে ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপিত হতে হয়। অর্থাৎ কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী অন্য যে ঘটনা অনিবার্যভাবে সংগঠিত হয়েছে তার ধারাবাহিক বিবরণ থাকা দরকার।

মন্তব্যসমূহ

আলী হোসেনের বহুল-পঠিত উক্তিগুলো পড়ুন

ধর্মের নামে রাজনীতিই প্রমাণ করে আমরা মধ্যযুগীয়

ধর্মের নামে রাজনীতিই প্রমাণ করে আমরা মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষে এখনও যে ধর্মের নামে রাজনীতি হয় বা হচ্ছে, তাতেই প্রমাণ হয় আমরা আধুনিক নয়, চিন্তায়-চেতনায় এখনো মধ্যযুগে বাস করি। কারণ, আধুনিক যুগের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য আছে। কোন জাতি, নিজেকে আধুনিক বলে দাবি করতে চাইলে, এই বৈশিষ্ট্যগুলো তাদের মধ্যে থাকা প্রয়োজন। এর মধ্যে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো হল ধর্ম-মুক্ত রাজনীতি। পৃথিবীর যেখানে যেখানে রাজনীতি ধর্মমুক্ত হয়েছে, সেখানে সেখানে রাজনৈতিক হিংসা হানাহানি অনেক কমে গেছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা, যা আধুনিকতার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর দিকে তাকালেই বুঝতে পারা যায় ধর্মের সঙ্গে রাজনীতি সম্পর্কিত থাকলে কি ভয়ংকর রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়। বোঝা যায়, কীভাবে নিরবিচ্ছিন্ন অস্থিরতা ও রাজনৈতিক হিংসা এবং প্রতিহিংসার দাপটে একটা জাতি শতধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। মূলত এ কারণেই, অসংখ্য ছোট ছোট, বলা ভালো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়েছে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য। ফলে সাম্রাজ্যবাদী বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর নয়া সাম্রাজ্যবাদী নাগপাশ ...

ধর্ম দিয়ে ধর্মান্ধতা দূর করা যায় না।

ধর্ম দিয়ে ধর্মান্ধতা দূর করা যায় না। কারণ দুটোরই ভিত্তি হচ্ছে যুক্তিবিমুখ বিশ্বাস। তাই, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা হয়তো যায়। কিন্তু ধর্ম দিয়ে ধর্মান্ধতা দূর করা কখনই যায় না। একথা ভুলতে বসেছেন যাঁরা, তাঁরা নিজেদের প্রগতিশীল দাবি করতেই পারেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এতে প্রগতিশীলতা গতিলাভ করে না বরং গতি হারায়। --------x------- Di Ansar Ali হ্যা, পরিস্থিতি অনুযায়ী সমঝোতা করতে হয়। কিন্তু মাথায় রাখতে হয়, তাতে আমার সত্যিই কোনো লাভ হচ্ছে কিনা। এবং তার অদূর ও সুদূরপ্রসারী ফলাফল প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করাটা মোটেই যুক্তিযুক্ত নয় বলেই মনে হয়। কারণ, তাতে পরের যাত্রা হয়তো ভঙ্গ হয়, কিন্তু নিজের শরীরে ভয়ঙ্কর ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়ার দখলদারি বেড়ে যেতে পারে। আমার মনে হয়, এই হিসাবটা ঠিকঠাক না করতে পারলে পরিস্থিতি অনুকূলে আসার পরিবর্তে প্রতিকূলে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। এক্ষেত্রে 'দশচক্রে ভগবান ভুত হওয়ার' বিষয়টিও মাথায় রাখার প্রয়োজন খুব বেশি বলেই আমি মনে করি। যারা প্রগতিশীল নয়, বলে এতদিন বলে আসছি তারা যদি হঠাৎ করে প্রগতিশীল হয়ে ওঠে তবে, ...

বিজেপি ও আরএসএস কি আলাদা?

বিজেপি ও আরএসএস কি আলাদা? বিজেপি ও আরএসএস-এর রসায়ন সম্পর্কে সম্যক অবহিত আছেন, এমন মানুষদের সবাই জানেন বিজেপির সঙ্গে আরএসএস-এর গভীর সম্পর্কের কথা। এবং তাঁরা এটাও জানেন যে, আরএসএস দ্বারা বিজেপি নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। তাই এই দুই সংগঠনকে আপাতদৃষ্টিতে আলাদা মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এরা আলাদা নয়। বরং এরা একে অপরের পরিপূরক। বিস্তারিত দেখুন এখানে ক্লিক করে

বিজ্ঞান শিক্ষার পরিবর্তে ধর্মশিক্ষার প্রচলন ও তার পরিণতি

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্ম শিক্ষার প্রভাব দেশের বড় বড় বিজ্ঞান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেভাবে বেদ ও পুরাণসহ ধর্মশাস্ত্র পড়ানোর ধুম লেগেছে তাতে ভারতবর্ষ খুব তাড়াতাড়ি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মত অশিক্ষার কানাগলিতে ঢুকে যাবে। এভাবে চলতে থাকলে,বলা ভালো যেতে বাধ্য হবে। শিবপুর আই আই ই এস টি তে যেভাবে বেদ ও পুরাণ ভিত্তিক কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে তাতে এই আশঙ্কা প্রকট হয়ে উঠছে। সেই সঙ্গে গোলওয়ালকরের ছবি ও বই রেখে যেভাবে বিচ্ছিন্নতা ও সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন মতাদর্শকে হাইলাইট করা হচ্ছে তাতে ভারতের ভবিষ্যত দুর্দশার রূপটি স্পস্ট হয়ে উঠছে। বিস্তারিত পড়তে এখানে ক্লিক করুন ফেসবুকে দেখুন এখানে ক্লিক করে