শিক্ষা ও লেখাপড়ার মধ্যে সম্পর্ক কী?
শিক্ষা হল একটি চলমান প্রক্রিয়া। এর শেষ হয় না। কিন্তু লেখাপড়া শেষ হয়। সর্বোচ্চ ডিগ্রি প্রাপ্তির মাধ্যমে তার সমাপ্তি ঘটে। তাই লেখাপড়া জানা মানুষ মাত্রই পূর্নমত্রায় শিক্ষিত হবেন তা কখনই বলা যায় না।
লেখাপড়া শেষ করেই তাই প্রত্যেক মানুষের পড়াশোনা শুরু করা উচিত। এটা না করলে একজন মানুষ লেখাপড়ার মাধ্যমে যে শিক্ষা অর্জন করেছেন তা ক্রমশ হারাতে থাকবেন। একটা সময় গিয়ে তিনি তথাকথিত শিক্ষিত মানুষে রূপান্তরিত হয়ে যাবেন।
শিক্ষিত হওয়ার এই প্রক্রিয়া মৃত্যুর মুহূর্ত পর্যন্ত চলমান থাকে। কারণ, এই সময়ও মানুষ কিছু উপলব্ধি করে যা সে এর পূর্বে করেনি। আর সেটা হল মৃত্যুর স্বাদ বা যন্ত্রনা যা এক বিশেষ ধরণের শিক্ষার জন্ম দেয়। কিন্তু এই অর্জিত শিক্ষা মানুষ তার জীবনে কাজে লাগাতে পারেন না। পৃথিবীতে এই একমাত্র শিক্ষা মানুষ লাভ করে যা সে চাইলেও তার জীবনে কাজে লাগাতে পারবেন না (এখনও পর্যন্ত, ভবিষ্যত জানিনা)।
আসলে শিক্ষা আর লেখাপড়া দুটো ভিন্ন বিষয়। তবে উভয়ের সম্পর্ক গভীর। এরা একে অপরের পরিপূরক নয় বটে, তবে একমুখী এবং সমান্তরাল বলা যায়।
লেখাপড়া কী?
লেখাপড়া আসলে শিক্ষা অর্জনের একটা মাধ্যম। নদীর এক পাড় থেকে অন্য পাড়ে যেতে যেমন একটা মাধ্যম লাগে, লেখাপড়া তেমনই একটি মাধ্যম যেটাকে অবলম্বন করে আমরা একটা পর্ব পর্যন্ত শিক্ষা অর্জন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারি।
নদীর অন্য পাড়ে পৌঁছাতে আমরা যেমন সাঁতারকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে পারি, তেমনই নৌকা বা স্পিড বোর্ডও ব্যবহার করতে পারি। সাঁতার বেশি সময় নেবে এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর ব্যাপারে অনেকটাই অনিশ্চয়তা থাকবে। নৌকা একটু কম সময় নেবে। অন্য দিকে স্পীডবোর্ড অনেকটাই কম সময় নেবে এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারাকে অনেকটাই নিশ্চিত করবে। লেখাপড়াকে আমরা এই স্পিড বোর্ড এর সঙ্গে তুলনা করতে পারি।
সুতরাং লেখাপড়া শেখা মানেই শিক্ষিত হয়ে যাওয়া নয়, পূর্ণমাত্রায় তো নয়ই। সারাদিন সাঁতরেও যেমন সঠিক সময় সঠিক পাড়ে না পৌঁছানোর সম্ভাবনা থাকে, তেমনই সারা জীবন লেখাপড়া শিখেও আপনি শিক্ষার দোরগোড়ায় পৌঁছাতে নাও পারেন। গভীরে যাওয়া তো অনেক দূর। কারণ গভীরে যাওয়া একজীবনে কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। কেননা জ্ঞানের শিক্ষার ক্ষেত্র সসীম নয়, অসীম।
শিক্ষাটা আসলে কী?
এক কথায় জগত ও জীবনের প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করাই হল শিক্ষা। প্রকৃত সত্য কী? প্রকৃত সত্য হল এক বিশেষ ধরণের নিয়ম বা বিধিবিধান যা প্রকৃতি জগত মেনে চলে বা তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এককথায় সেটা হল প্রাকৃতিক নিয়ম। মানুষ ছাড়া জগতের সমস্ত প্রাণী এই নিয়ম মেনে চলে। ভাঙে কেবল মানুষ। লোভের বশবর্তী হয়ে। প্রকৃতির এই নিয়ম কী? তা মানলে কী সুবিধা, ভাঙলেই বা কী ক্ষতি হবে তা সঠিকভাবে সঠিক স্তর পর্যন্ত উপলব্ধি করাই হল শিক্ষা। সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভের পরেও যদি কেউ এই উপলব্ধি না করতে পারেন, তবে তিনি শিক্ষিত দাবি করতে পারেন না।
যুগ যুগ ধরে মানুষ এই সত্যের (প্রাকৃতিক নিয়মের) খোঁজ করে চলেছেন। চলছেন প্রধানত দুই শাখায় বিভক্ত হয়ে। একটি বস্তুবাদী ধারায়,অন্যটি আধ্যাত্মিক ধারায়। দুই তরফই খুঁজে চলেছেন এই প্রাকৃতিক নিয়ম। বস্তুবাদীরা তার নাম দিয়েছেন বিজ্ঞান বা বিশেষ জ্ঞানের অনুসন্ধান আর আধ্যাত্মবাদীরা সেটাকেই বলছেন ধর্ম দর্শন। ধর্মগ্রন্থগলো গভীরভাবে অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এই নিয়মের বর্ননা করা হয়েছে সেখানে।
তাহলে ধর্ম দর্শন ও বিজ্ঞান কী এক? মোটেই না। উভয়ের মধ্যে রয়েছে গভীর পার্থক্য। পার্থক্যটা মতের চেয়ে পথের বেশি।
ধর্ম শুরু করে বিশ্বাসকে ভিত্তি করে। অন্যদিকে বিজ্ঞান শুরু করেছে অবিশ্বাস ও নিরন্তর অনুসন্ধানকে ভিত্তিভুমি ধরে।
বিজ্ঞান তার খুঁজে পাওয়া জ্ঞানকে কখনই চিরকালীন বলে দাবি করে না। কিন্ত ধর্ম দর্শনের চর্চায় নিমগ্ন কোন দার্শনিক যখন কোন সত্য খুঁজে পান তিনি তা ব্যখ্যা করে যান সেই সময়ের প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে। কিন্তু পরবর্তীকালে তার অনুগামীরা সেটাকেই চরম ও পরম সত্য বলে ধরে নিয়েছেন। সেখান থেকে আর এগোতে দেওয়া হয়নি। ফলে বিজ্ঞানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ধর্ম দর্শন এগোতে পারেনি।
সুতরাং ধর্ম ও বিজ্ঞান একই লক্ষ্যে ধাবিত দুই ভিন্ন পথের অনুসারী অভিযান। তাই এই দুটো একে অপরের পরিপূরক তো নয়ই একটাকে দিয়ে আর একটাকে ব্যাখ্যা করা বা প্রমাণ করা যায় না।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন