শিক্ষা ও লেখাপড়ার মধ্যে সম্পর্ক কী?
শিক্ষা হল একটি চলমান প্রক্রিয়া। এর শেষ হয় না। কিন্তু লেখাপড়া শেষ হয়। সর্বোচ্চ ডিগ্রি প্রাপ্তির মাধ্যমে তার সমাপ্তি ঘটে। তাই লেখাপড়া জানা মানুষ যে মাত্রই পূর্নমত্রায় শিক্ষিত হবেন, তা কখনই দায়িত্ব নিয়ে বলা যায় না।
লেখাপড়া শেষ করে তাই প্রত্যেক মানুষকে পড়াশোনা শুরু করতে হয়। এটা না করলে, একজন মানুষ লেখাপড়ার মাধ্যমে যে শিক্ষা অর্জন করেছেন, তা ক্রমশ হারাতে থাকেন। একটা সময় গিয়ে সে ‘তথাকথিত শিক্ষিত’ মানুষে রূপান্তরিত হয়ে যাবে।
শিক্ষিত হওয়ার এই প্রক্রিয়া মৃত্যুর মুহূর্ত পর্যন্ত চলমান থাকে। কারণ,
১) এই সময়কালের মধ্যে মানুষ তার জানা বিষয়ের মধ্যে থেকে এমন কিছু উপলব্ধি নতুনভাবে করতে পারে, যা সে এর পূর্বে করেনি।
২) প্রতি মুহূর্তে পৃথিবীতে ঘটে চলেছে নানান পরিবর্তন। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সর্বোপরি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে নতুন নতুন গবেষণা ও আবিষ্কার জানা বোঝার জগতকে পাল্টে দেয়। এই পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে (অর্থাৎ আপডেট করতে) না পারলে একজন লেখাপড়া জানা মানুষও আস্তে আস্তে শিক্ষাহীন মানুষে স্তরে নেমে আসতে বাধ্য হয়।
৩) সেই সঙ্গে এমন কিছু বিষয় আছে, যা বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথেই কেবল অর্জন করা যায়। সেটা হল মৃত্যুভয় বা বার্ধক্য জনিত রোগ ও সে সংক্রান্ত যন্ত্রনা যা মানুষকে এক বিশেষ ধরণের শিক্ষার সামনাসামনি এনে দাঁড় করায়। যদিও এই অর্জিত শিক্ষা মানুষ তার জীবনে কতটা ও কীভাবে কাজে লাগাতে পারবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। পৃথিবীতে মৃত্যু মুখোমুখি দাঁড়িয়েও মানুষ এমন কিছু শিক্ষা লাভ করে, যা সে চাইলেও তার জীবনে একে কাজে লাগাতে পারবেন না (এখনও পর্যন্ত, ভবিষ্যত জানিনা)।
আসলে শিক্ষা আর লেখাপড়া দুটো ভিন্ন বিষয়। তবে উভয়ের সম্পর্ক গভীর। এরা একে অপরের পরিপূরক নয় বটে, তবে একমুখী এবং অনেকটাই সমান্তরাল বলা যায়। কারণ, লেখাপড়া যত বাড়ে, শিক্ষা অর্জন ততো সহজ হয়ে ওঠে।
লেখাপড়া কী?
লেখাপড়া আসলে শিক্ষা অর্জনের একটা মাধ্যম। নদীর এক পাড় থেকে অন্য পাড়ে যেতে যেমন একটা মাধ্যম লাগে, লেখাপড়া তেমনই একটি মাধ্যম, যেটাকে অবলম্বন করে মানুষ একটা পর্ব পর্যন্ত শিক্ষা অর্জন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারি।
নদীর অন্য পাড়ে পৌঁছাতে আমরা যেমন সাঁতারকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে পারি, তেমনই নৌকা বা স্পিড বোর্ডও ব্যবহার করতে পারি। সাঁতার বেশি সময় নেবে এবং এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর ব্যাপারে অনেকটাই অনিশ্চয়তা থাকবে। নৌকা একটু কম সময় নেবে। অন্যদিকে স্পীডবোর্ড অনেকটা কম সময় নিয়ে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর কাজকে অনেকটাই নিশ্চিত করতে পারে। লেখাপড়াকে আমরা এই স্পিড বোর্ড-এর সঙ্গে তুলনা করতে পারি। লেখাপড়া অনেকটা স্প্রিম কোর্টের মতো কম সময় নিয়ে শিক্ষার অসীম সাগরে পাড়ি দেওয়াকে অনেকটাই সহজ করে তোলে।
তবে লেখাপড়া শেখা মানেই কিন্তু শিক্ষিত হয়ে যাওয়া নয়, পূর্ণমাত্রায় তো নয়ই। সারাদিন সাঁতরেও যেমন সঠিক সময় সঠিক পাড়ে না পৌঁছানোর সম্ভাবনা থাকে, তেমনই সারা জীবন লেখাপড়া শিখেও আমি বা আপনি শিক্ষার দোরগোড়ায় পৌঁছাতে নাও পারি। গভীরে যাওয়া তো অনেক দূর। কারণ, গভীরে যাওয়া একজীবনে কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। কেননা জ্ঞান ও শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্র সসীম নয়, অসীম।
শিক্ষাটা আসলে কী?
এক কথায় জগত ও জীবনের চালিকাশক্তি সংক্রান্ত প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করাই হল শিক্ষা। প্রকৃত সত্য কী? প্রকৃত সত্য হল এক বিশেষ ধরণের আইন, নিয়ম বা বিধিবিধান, যা প্রকৃতি জগৎ নিষ্ঠার সঙ্গে মেনে চলে। বলা ভালো এই নিয়মের দ্বারা সে নিয়ন্ত্রিত বা পরিচালিত হয়। এককথায়, এই আইন বা বিধি বিধানকে আমরা বলি প্রাকৃতিক নিয়ম। একমাত্র মানুষ ছাড়া জগতের সমস্ত প্রাণী এই নিয়ম মেনে চলে। ভাঙে কেবল মানুষ। লোভের বশবর্তী হয়ে। প্রকৃতির এই নিয়ম কী? তা মানলে কী সুবিধা, ভাঙলেই বা কী ক্ষতি হবে তা সঠিকভাবে সঠিক স্তর পর্যন্ত উপলব্ধি করার নামই হল শিক্ষা। সর্বোচ্চ প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি লাভের পরেও যদি কেউ এই উপলব্ধি না করতে পারেন, তবে তিনি লেখাপড়া জানা মানুষ দাবি করতে পারেন, শিক্ষিত দাবি করতে পারবেন না।
প্রাকৃতিক নিয়ম ছাড়াও মানুষের জীবন আরো এক ধরনের আইন বা বিধিবিধানের দ্বারা পরিচালিত বা নিয়ন্ত্রিত হয়। এই আইনকে বলা হয় রাষ্ট্রীয় আইন। লেখাপড়া শেখার প্রথম উদ্দেশ্য হল প্রাকৃতিক নিয়ম জানা, বোঝা এবং তাকে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করার সক্ষমতা অর্জন করা। আর দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হলো রাষ্ট্রীয় আইন সম্পর্কে জানা বোঝা এবং তাকে প্রয়োগ করার সক্ষমতা অর্জন করা। এই দুটো নিয়ম একজন মানুষ যতটা জানেন, বোঝেন এবং তা প্রয়োগ করার মধ্য দিয়ে নিজের এবং দেশের মানুষের কল্যাণের কাজে লাগার সক্ষমতা অর্জন করেন, তিনি ততটাই শিক্ষিত। কোন বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া ঝকঝকে সার্টিফিকেট দ্বারা তা নিশ্চিত করা যায় না। গাছের পাতা কেন নড়ে, বৃষ্টি কেন পড়ে, কোন নিয়মে এসব কর্মকাণ্ড হয় তা জানার জন্য আমরা পড়ি ভূগোল। কেন খিদে লাগে, কেন রোগ হয়, কি করলে রোগ প্রতিরোধ করা যায় তার নিয়ম জানা যায় জীবন বিজ্ঞান তথা চিকিৎসা বিজ্ঞানের মাধ্যমে। এমন সব অসংখ্য ঘটনা ঘটে যে নিয়মকে অনুসরণ করে, সেটাই প্রাকৃতিক নিয়ম। অন্যদিকে রাষ্ট্রের আইন কানুন পড়েই আমাদের শিখতে হয় রাস্তায় কোন দিক দিয়ে হাটবো, কিভাবে হাঁটবো, কখন হাঁটবো কিংবা হাঁটবো না তা। এমন হাজারও নিয়ম-কানুনের মোড়কে বাধা আছে আমাদের ব্যক্তি জীবন, সমাজ জীবন, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবন। এই নিয়মগুলি আমরা যতটা জানি , যতটা বুঝি এবং তা ঠিকঠাক (সফলভাবে) প্রয়োগ করার সক্ষমতা অর্জন করেছি, আমরা ঠিক ততটাই শিক্ষিত।
কীভাবে শিক্ষা অর্জন :
যুগ যুগ ধরে মানুষ এই সত্যের (প্রাকৃতিক নিয়মের) খোঁজ করে চলেছেন। চলছেন প্রধানত দুই শাখায় বিভক্ত হয়ে। একটি বস্তুবাদী ধারায়। অন্যটি আধ্যাত্মিক ধারায়। দুই তরফই খুঁজে চলেছেন এই প্রাকৃতিক নিয়ম। বস্তুবাদীরা তার নাম দিয়েছেন বিজ্ঞান বা বিশেষ-জ্ঞানের অনুসন্ধান। আর আধ্যাত্মবাদীরা সেটাকেই বলছেন ধর্মদর্শন। ধর্মগ্রন্থগলো গভীরভাবে অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এই নিয়মের বর্ননা করা হয়েছে সেখানে।
তাহলে ধর্মদর্শন ও বিজ্ঞান কী এক? মোটেই না। উভয়ের মধ্যে রয়েছে গভীর পার্থক্য। পার্থক্যটা মতের চেয়ে, পথের বেশি।
ধর্ম দর্শন যাত্রা শুরু করে একটি প্রচলিত অলৌকিক সত্তার ওপর বিশ্বাসকে ভিত্তি করে। অন্যদিকে বিজ্ঞান তাঁর যাত্রা শুরু করে প্রচলিত অলৌকিক সত্তায় অবিশ্বাস করে এবং নিরন্তর অনুসন্ধানকে ভিত্তিভুমি ধরে।
বিজ্ঞান তার খুঁজে পাওয়া জ্ঞানকে কখনই চিরকালীন বলে দাবি করে না, যতক্ষণ না তা যুক্তি বুদ্ধি ও তথ্যের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পর্যবেক্ষণ পরীক্ষণ ও প্রয়োগের মাধ্যমে তা নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়। কিন্ত ধর্মদর্শনের চর্চায় নিমগ্ন কোন দার্শনিক যখন কোন সত্য খুঁজে পান, তিনি তা ব্যখ্যা করে যান সেই সময়ের প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে। কিন্তু পরবর্তীকালে তাঁর অনুগামীরা সেটাকেই চরম, পরম ও অপরিবর্তনীয় সত্য বলে ধরে নেয়। সেখান থেকে আর এগোতে দেওয়া হয় না। ফলে বিজ্ঞানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ধর্মদর্শন এগোতে পারেনি।
এখন ধর্ম দর্শন ও বিজ্ঞানের এই যে মৌলিক পার্থক্য এটা বোঝা খুব সহজ নয়। কারণ, সত্য সহজবোদ্ধ নয়। তাকে অর্জন করতে গেলে লাগে যে শিক্ষা, তা অর্জনের একমাত্র পথ হল মুক্তমনে জগৎ ও জীবনের চালিকা শক্তির নিয়ন্ত্রক যে প্রাকৃতিক ও রাষ্ট্রীয় নিয়ম, তাকে জানা, বোঝা এবং তাকে প্রয়োগ করে সফল হওয়ার সক্ষমতা অর্জন করা। এই অর্জন একমাত্র লেখাপড়া, পড়াশোনা, এবং সর্বোপরি গবেষণার মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব। সুতরাং শিক্ষার সঙ্গে লেখাপড়ার সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর।
যদিও ধর্ম ও বিজ্ঞান একই উদ্দেশ্যে ধাবিত দুই ভিন্ন পথের কিন্তু একই লক্ষের অনুসারী অভিযান। তাই এই দুটো একে অপরের পরিপূরক তো নয়ই, একটাকে দিয়ে আর একটাকে ব্যাখ্যা বা প্রমাণ করাও তাই অত্যন্ত কঠিন এবং অবশ্যই হাস্যকর।
------------xx-----------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন