সত্য সহজবোদ্ধ নয় :
The truth is not easy to understand
সত্যকে সহজে দেখা যায় না। কারণ, সত্য নিজেই নিজেকে একটা অদৃশ্য মোড়কে মুড়ে রাখে। এই মোড়ক তাকে সুরক্ষা দেয়, তাকে মূল্যবান করে তোলে।আমরা আমাদের শরীরের মূল্যবান অংশগুলিকে বাইরে থেকে দেখতে পাই না। অথচ তারাই আমার দেহের মূল চালিকাশক্তি। সেই চালিকাশক্তিই হল প্রকৃত সত্য। সে নিজেকে রক্ষা করছে, ত্বক, পাঁজর, চুল ইত্যাদি নানান ধরনের বাইরের আবরণ বা মোড়কের সাহায্যে। তেমনি আমরা দেখছি সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে। কিন্তু আসল সত্য হল— সূর্য নয়, পৃথিবীই সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে। 
সুতরাং সত্যকে উপলব্ধি করতে গেলে নিবিড় গবেষণা প্রয়োজন। লেখাপড়া শেষ করে, এর জন্য প্রয়োজন হয় জগৎ ও জীবন সম্পর্কে নিরবিচ্ছিন্ন এবং সার্বিক পড়াশোনা। প্রয়োজন হয় পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ-সহ সর্বাধুনিক গবেষণা করার সর্বাধুনিক রীতিনীতি ও টুলস ব্যবহার করার সক্ষমতা। আমি যদি তা না করতে পারি অর্থাৎ এগুলো ব্যবহারের সক্ষমতা যদি আমার না থাকে, তবে আমার কাছে যা সত্য হিসাবে উপস্থিত হবে, তা সব সময় সত্য নাও হতে পারে। হতে পারে তা সত্যের আবরণ মাত্র।
অর্থাৎ আপনি যা সহজেই বুঝে ফেলছেন, তা আসলে প্রকৃতপক্ষে সত্য নাও হতে পারে। ধরুন একজন দেখছেন, মুসলিম ধর্ম-বিশ্বাসীরা সাম্প্রদায়িক। তারাই এদেশে এবং সারা পৃথিবীতে একমাত্র মৌলবাদী কার্যকলাপ সংঘটিত করছে। তার সামনে রয়েছে গাদা গাদা দৃষ্টান্ত, যা দিয়ে তা প্রমাণের দাবিও করা যায়। আরেকজন দেখছেন, মুসলিমরা কোথায় মৌলবাদী! প্রকৃত মৌলবাদী তো হিন্দু সম্প্রদায়ের ভন্ড ধর্ম ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকরা। তাহলে প্রশ্ন হল, কোনটা সত্য? প্রকৃত সত্য তো এমন পরস্পর বিপরীতমুখী ও বিপরীত ধর্মী অবস্থানে থাকে না!
আসলে, প্রকৃত সত্য এই দুই ভাবনার কোনটার মধ্যেই নেই। যা আছে তা আসলে দুটি মোড়ক বা আবরণ। এই আবরণ মানুষের তৈরি করা। বলা ভালো, কিছু ধান্দাবাজ মানুষের তৈরি করা। এভাবেই তারা আমাদেরকে দেখাচ্ছে, আর আমরা সেভাবেই তা দেখছি। ভাবছি এটাই সত্য। কিন্তু প্রকৃত সত্য এই দুটোর কোনটার মধ্যেই নেই। 
ইসলাম একটি ধর্মীয় দর্শন। যার মূল ভিত্তি কোরআন। আমরা যাকে হিন্দু ধর্ম বলি সেটাও একটা ধর্মদর্শন। ধর্মতাত্ত্বিকরা যদিও সঙ্গত কারণেই ‘হিন্দু ধর্ম’ না বলে, বৈদিক ধর্ম বা সনাতন ধর্ম নামে অভিহিত করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। আর এই ধর্মের মূল ভিত্তি হল বেদ। এখন এই দুই ধর্মের যে ধর্মীয় দর্শন সেখানে মানব প্রেম এবং নিঃস্বার্থভাবে মানব সেবায় কাজ করে যাওয়াকেই মানুষের প্রধান কর্তব্য হিসেবে বার বার ব্যাখ্যা করা হয়েছে। দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে মানুষকে সম্মুখীন হতে হয় নানান বাধা-বিপত্তির। স্বার্থান্বেষী ও কুচক্রী কিছু মানুষ ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার জন্য এই বাধা-বিপত্তি সৃষ্টি করে। এবং তাদের এই কুকর্মের সাফাই দেওয়ার জন্য তারা ধর্মকে আশ্রয় করে। শুধু আশ্রয় গ্রহণ করেই এরা ক্ষান্ত থাকেন না, তৈরি করে ধর্মের নামে নতুন নতুন তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা ও বয়ান। কালক্রমে, মূল ধর্মগ্রন্থগুলো চাপা পড়ে যায় এবং তাদের তৈরি করা বয়ানগুলোই ধর্মের মূল চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে। এভাবেই মানুষের কাছে বেদের চেয়ে পুরানগুলো বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। ঠিক একইভাবে, কোরআনের জায়গায় হাদিস এবং শরিয়তি আইনগুলো মুসলিম সমাজের চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে।
ধরুন, আপনি দৈনন্দিন কাজকর্ম করার জন্য একটি ধারালো অস্ত্র কিনেছেন। এই অস্ত্র, আপনাকে কঠিন কাজ সহজে করার সুযোগ করে দিচ্ছে। একদিন লোভের বলে আপনি এই অস্ত্র দিয়ে একজন নিরপরাধ মানুষকে খুন করলেন। এটা হল এই অস্ত্রের অপব্যবহার। যিনি করলেন, তিনি অপব্যবহারকারী। নিজের কাছে প্রশ্ন করলেই জানতে পারবেন, আপনার বিবেক, বিবেচনাবোধ, যুক্তিবাদী চেতনা, বিজ্ঞানমনস্ক মন জানাবে এই অস্ত্র নয়, অস্ত্র ব্যবহারকারীই আসলে অপরাধী। কারণ তিনি তার অপব্যবহার করেছেন। আর অস্ত্র নিজে নিজে কখনোই কারও কোন ক্ষতি বা লাভ কিছুই করতে পারে না।
ইসলাম হোক, হিন্দু বা বৈদিক হোক, কিংবা হোক অন্য কোন ধর্ম, সে তো আসলেই একটি ধর্ম দর্শন। যা মানুষের অসদআচরণ, মানব সভ্যতার পরিপন্থী কর্মকাণ্ডকে সহজে নিয়ন্ত্রণ করার কাজে ব্যবহার করার জন্যই তৈরি হয়েছে। তাই এটা একটা অস্ত্র, যা মানুষকে সুরক্ষা দেয়। এখন যদি কোন ব্যক্তি এই অস্ত্রটাকে ব্যবহার করে মানুষের ক্ষতি করে, তাহলে দোষটা কার, ওই ব্যবহারকারীর না ঐ অস্ত্রটার? প্রকৃত সত্য হল এই অস্ত্র নয়, অস্ত্র ব্যবহারকারীই হল আসল অপরাধী।
কিন্তু আমরা কী ভাবি? ভাবি, ধর্মই সকল অনিষ্টের মূল। এটা কি আমি এমনি এমনি ভাবি? না। এই ভাবনাটা আমাদের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। কারা ঢোকায়? যারা ঢোকায়, তারা মূলত সেই রাজনীতিক, যারা প্রকৃত শিক্ষার আলোর বাইরে থাকা মানুষের শ্রমকে ফাঁকি ও মেধাকে শোষন করার কাজে ধর্মকে ব্যবহার করে। শ্রমজীবী মানুষের শ্রম ও মেধাকে শোষন করার জন্য মানুষের মধ্যে বিভাজনই হল সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। আর এই অস্ত্রকে চালানোর সবচেয়ে সহজলভ্য এনার্জির যোগান দেয় তাদেরই তৈরি রা অথবা তাদের প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় শক্তিশালী হওয়া ধর্মের নামে এই বিকৃত ধর্ম দর্শন।
এখন প্রশ্ন হল, আমরা কি এসব বুঝি? উত্তর হল, না। আমরা অধিকাংশ মানুষই এটা বুঝিনা। তার কারণ, সত্য সহজবোদ্ধ নয়। আগেই বলেছি, সত্যকে জানতে এবং বুঝতে গেলে কী কী লাগে এবং কীভাবে তা অর্জন করতে হয়। আপনি যদি লেখাপড়া শেষ করে পড়াশোনায় মনোযোগ না দেন এই অর্জন আপনার জন্য অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। সত্যের আবরণকে আপনি সত্য বলে ভাববেন। তাকেই আপন বলে জড়িয়ে ধরবেন। আর এই সুযোগে আপনি আস্তে আস্তে রক্তশূন্য হয়ে অকালে ঝরে পড়বেন। মজার কথা হল, আপনি যখন ঝরে পড়বেন, এরাই আপনার পাশে এসে দাঁড়াবেন এবং সান্ত্বনা দেবেন এই বলে, ‘সবই সে-জনের ইচ্ছা! আমরা তো নিমিত্ত মাত্র।’
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন