সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

গো হত্যা, এ অন্ধত্ব কাটবে কবে?

গরিব মানুষ গরুর মাংস খেলে বা তা নিয়ে ব্যবসা করলে গোমাতা হত্যার অপরাধ হয়। আর কর্পোরেট ব্যবসায়ীরা গো হত্যা করে বিদেশে মাংস রপ্তানি করলে তা অপরাধ নয়।

সাধারণ জনগণ এই সত্য জানা সত্বেও অন্ধ হয়ে থাকে কি করে? এ অন্ধত্ব কাটবে কবে?

এই মুহূর্তে গোটা পৃথিবীতে গো-মাংস রপ্তানিতে ভারত শীর্ষ স্থান অধিকার করে রেখেছে। সারা পৃথিবীর ১৯.৭ শতাংশ গোমাংস ভারত একাই রপ্তানি করে।

গরিব মানুষ করলে গো হত্যা আর কর্পোরেট ব্যবসায়ীরা করলে বৈদেশিক মুদ্রা?

মনে রাখা দরকার, ঋকবেদে দেবরাজ ইন্দ্র একাধিক শ্লোকে বলেছেন,  পঁয়ত্রিশটি বলদ, ষাড়, তিনশত মহিষ আগুনে পুড়িয়ে রোস্ট করে তাকে খেতে দেয়া হয়েছে। দেবতা অগ্নির প্রিয় খাদ্য ছিল গরু, মহিষ, বলদ, ঘোড়া ইত্যাদির মাংস। দেবতাদের খাদ্যাভ্যাস যে সম্পূর্ণ দুগ্ধজাত দ্রব্য ও গো-মাংসের উপর নির্ভরশীল ছিল তার অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে ঋকবেদে। অশ্বমেধ যজ্ঞে গো উৎসর্গ ছিল প্রধানতম রীতি। ঋগ্বেদ পরবর্তী তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ, তৈত্তিরীয় সংহিতা, গোপথ ব্রাহ্মণ বা অথর্ব বেদে খাদ্য হিসাবে যে গোমাংসের উৎকর্ষতা স্বীকার করা হয়েছে একথা বেদ খুললেই জানা যায়।

শুধু তাই নয়, ঋগ্বেদ পরবর্তী একাধিক গ্রন্থে গৃহে অতিথি আসলে অর্ঘ্য বা মধুপোক নামক অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে, যার প্রাথমিক আচারই হলো একটি গাভীকে বধ্ করে তার মাংস খেতে দেওয়া। এমনকি শ্রাদ্ধ বা অভ্যুদায়া অনুষ্ঠানেও গোমাংস উৎসর্গ করা হতো পিতৃপুরুষের রসনা তৃপ্তির জন্য। 

প্রশ্ন হল সনাতন (হিন্দু নয়, কারণ হিন্দু কোন ধর্ম নয়) ধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদেই যখন এই রীতি রিয়াজের স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে, তখন হিন্দুত্ববাদীরা কোন যুক্তিতে গোমাংসের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন?

এর উত্তর রয়েছে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকদের সুপরিকল্পিত ন্যারেটিভের মধ্যে। কিছু আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিকে ধর্মীয় মোড়কে জারিত করে রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার সুপরিকল্পিত প্রয়াসের মধ্যে।

হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী এই ন্যারেটিভ তৈরিতে ‘অঘ্ন্য’ শব্দটি সুচতুরভাবে ব্যবহার করেছেন। এই শব্দটির ওপর গুরুত্ব দিয়ে তারা দাবি করেন প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতিতে গরু ছিল অবধ্য। কিন্তু এটি একটি সম্পূর্ণ মিথ্যাচার। কারণ, এই শব্দটি ঋকবেদে মাত্র চার বার ব্যবহৃত হয়েছে। অথচ গরুকে খাদ্য হিসাবে ব্যবহারের উদাহরণ অনেক অনেক বেশি বার। তবে ব্রাহ্মণকে যে  গরু দক্ষিণা হিসেবে দেওয়া হতো তা হত্যা করে দেওয়া হত না একথা অনেক ঐতিহাসিক ও গবেষকরা স্বীকার করেছেন। 

গোটা মৌর্য শাসনকালে গোমাংস ভক্ষণ এর চলছিল। 

মধ্যযুগের প্রারম্ভিক পর্যায়ে দেখা যায় গো হত্যার বিরুদ্ধে মতামত দানা বাঁধছে। কৃষি সভ্যতার বিস্তার, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের প্রভাবে অহিংসা নীতির প্রচার এবং ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের প্রভাবে এই সময় গরুকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা শুরু হয়। ব্যাসস্মৃতিতে গোমাংস গ্রহণকারীকে ব্রাহ্মণ্য তন্ত্রের প্রচারকদের দ্বারা ‘অন্ত্যজ’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। 

তু্র্কো-আফগান ও মুঘল শাসন প্রবর্তনের পর হিন্দু ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র নিজেদেরকে মুসলিমদের থেকে পৃথক হিসাবে প্রতিপন্ন করার অভিলাষে গো-সংরক্ষণের উপর জোর দেওয়া শুরু করে। প্রাক-ব্রিটিশ পর্বে হুমায়ুন, জাহাঙ্গীর এবং আকবরও হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের উন্নতির স্বার্থে বিভিন্ন সময়ে গো-হত্যা বন্ধের ফরমান জারি করে। বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন উৎসবের সময় এই নির্দেশ জারি করা হতো। ফলে উত্তেজনা থাকলেও তা ছিল যথেষ্ট নিয়ন্ত্রিত।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সময়কালে এই উত্তেজনা তথা গো-রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। হিন্দু মুসলমানের ঐক্য নষ্ট করে ব্রিটিশ শাসনকে ভারতে শক্তিশালী করার অভিলাষে এই রাজনীতি প্রাসঙ্গিক করে তোলে উপনিবেশিক শাসকরা। ফলে গোহত্যাকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের ভিত দুর্বল হতে শুরু করে। 

ফলে সময়ের সাথে সাথে গো-রাজনীতি ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে ওঠে। ১৮৭০ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত সময়কালে গোহত্যাকে নিয়ে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি শক্ত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে যায়। 

কিন্তু মহাত্মা গান্ধী ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করার পর তার অহিংস নীতি উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে অনেকটাই পিছনে হটতে বাধ্য করে। গান্ধীজীর প্রতি হিন্দুত্ববাদীদের ক্ষোভের অন্যতম একটি কারণ হলো গোরাজনীতি বিষয়ে গান্ধীজীর এই অবস্থান।

দুঃখের হলেও সত্যি স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতবর্ষে জাতীয় কংগ্রেসের নমনীয় মনোভাবের কারণে এই রাজনীতি চরম আকার ধারণ করে এবং কংগ্রেসকে সরিয়ে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা ভারতের রাজনীতিতে শক্তি বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়। উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা কংগ্রেসের ছত্রছায়ায় থেকেই তারা তাদের কর্মসূচি এবং পরিকল্পনা চালিয়েছে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে। স্বাধীনতা-উত্তর কংগ্রেসের এই সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতার কারণেই উগ্র জাতীয়তাবাদ বিজেপির কাছে শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পেরেছে।

বাবরি মসজিদ ভাঙার সময় কংগ্রেস প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও যে অভূতপর্ব নিষ্ক্রিয়তা দেখিয়েছেন তা বিজেপির হিন্দুত্ববাদী শক্তিকে এমন এক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে যেখান থেকে কংগ্রেসকে দূরবীণ দিয়ে দেখা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মাখনলাল ফোতেদার এবং স্বরাষ্ট্র সচিব মাধব গোডবলে তাদের আত্মীবনীতে সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন। সি কে জাফর শরীফ (তৎকালীন রেলমন্ত্রী) নরসিমা রাও এর সমালোচনা করে বলেছিলেন এই ঘটনার জন্য দেশ, সরকার এবং কংগ্রেসকে বড় মাসুল গুনতে হবে। তাঁর এই ভবিষ্যতবাণী আজ বাস্তবরূপ পেয়েছে।

কংগ্রেসের এই সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতা, সংখ্যাগুরুর ধর্মান্ধতা ও গো রাজনীতিতে কর্পোরেট পৃষ্পোষকতায় হিন্দুত্ববাদীরা আজ এক মহীরুহে পরিণত হয়েছে। কর্পোরেট ব্যবসায়ীরা গো মাংস রপ্তানিতে বিশ্বসেরা হলেও দোষ দেখেনা জনগন, কিন্তু গরিব মানুষ সস্তার প্রোটিনের অভাব পূরণে আহার কিম্বা ব্যবসা করলে গো হত্যার দায়ে শাস্তি পেতে হয়। হায় রে ভারতমাতা তোমার সন্তানদের এ অন্ধত্ব কাটবে কবে?


মন্তব্যসমূহ

আলী হোসেনের বহুল-পঠিত উক্তিগুলো পড়ুন

ধর্মের নামে রাজনীতিই প্রমাণ করে আমরা মধ্যযুগীয়

ধর্মের নামে রাজনীতিই প্রমাণ করে আমরা মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষে এখনও যে ধর্মের নামে রাজনীতি হয় বা হচ্ছে, তাতেই প্রমাণ হয় আমরা আধুনিক নয়, চিন্তায়-চেতনায় এখনো মধ্যযুগে বাস করি। কারণ, আধুনিক যুগের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য আছে। কোন জাতি, নিজেকে আধুনিক বলে দাবি করতে চাইলে, এই বৈশিষ্ট্যগুলো তাদের মধ্যে থাকা প্রয়োজন। এর মধ্যে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো হল ধর্ম-মুক্ত রাজনীতি। পৃথিবীর যেখানে যেখানে রাজনীতি ধর্মমুক্ত হয়েছে, সেখানে সেখানে রাজনৈতিক হিংসা হানাহানি অনেক কমে গেছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা, যা আধুনিকতার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর দিকে তাকালেই বুঝতে পারা যায় ধর্মের সঙ্গে রাজনীতি সম্পর্কিত থাকলে কি ভয়ংকর রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়। বোঝা যায়, কীভাবে নিরবিচ্ছিন্ন অস্থিরতা ও রাজনৈতিক হিংসা এবং প্রতিহিংসার দাপটে একটা জাতি শতধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। মূলত এ কারণেই, অসংখ্য ছোট ছোট, বলা ভালো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়েছে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য। ফলে সাম্রাজ্যবাদী বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর নয়া সাম্রাজ্যবাদী নাগপাশ

ধর্ম দিয়ে ধর্মান্ধতা দূর করা যায় না।

ধর্ম দিয়ে ধর্মান্ধতা দূর করা যায় না। কারণ দুটোরই ভিত্তি হচ্ছে যুক্তিবিমুখ বিশ্বাস। তাই, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা হয়তো যায়। কিন্তু ধর্ম দিয়ে ধর্মান্ধতা দূর করা কখনই যায় না। একথা ভুলতে বসেছেন যাঁরা, তাঁরা নিজেদের প্রগতিশীল দাবি করতেই পারেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এতে প্রগতিশীলতা গতিলাভ করে না বরং গতি হারায়। --------x------- Di Ansar Ali হ্যা, পরিস্থিতি অনুযায়ী সমঝোতা করতে হয়। কিন্তু মাথায় রাখতে হয়, তাতে আমার সত্যিই কোনো লাভ হচ্ছে কিনা। এবং তার অদূর ও সুদূরপ্রসারী ফলাফল প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করাটা মোটেই যুক্তিযুক্ত নয় বলেই মনে হয়। কারণ, তাতে পরের যাত্রা হয়তো ভঙ্গ হয়, কিন্তু নিজের শরীরে ভয়ঙ্কর ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়ার দখলদারি বেড়ে যেতে পারে। আমার মনে হয়, এই হিসাবটা ঠিকঠাক না করতে পারলে পরিস্থিতি অনুকূলে আসার পরিবর্তে প্রতিকূলে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। এক্ষেত্রে 'দশচক্রে ভগবান ভুত হওয়ার' বিষয়টিও মাথায় রাখার প্রয়োজন খুব বেশি বলেই আমি মনে করি। যারা প্রগতিশীল নয়, বলে এতদিন বলে আসছি তারা যদি হঠাৎ করে প্রগতিশীল হয়ে ওঠে তবে,

বিজেপি ও আরএসএস কি আলাদা?

বিজেপি ও আরএসএস-এর রসায়ন সম্পর্কে সম্যক অবহিত আছেন, এমন মানুষদের সবাই জানেন বিজেপির সঙ্গে আরএসএস-এর গভীর সম্পর্কের কথা। এবং তাঁরা এটাও জানেন যে, আরএসএস দ্বারা বিজেপি নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। তাই এই দুই সংগঠনকে আপাতদৃষ্টিতে আলাদা মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এরা আলাদা নয়। বরং এরা একে অপরের পরিপূরক। বিস্তারিত দেখুন এখানে ক্লিক করে

সব মানুষই আসলে এক-একজন পাগল

মানুষ আসলে কী? সব মানুষই আসলে এক-একজন পাগল। কেউ কাজ পাগল, কেউ ফাঁকিবাজিতে পাগল। কেউ গান পাগল, তো কেউ জ্ঞান পাগল। কেউ বা আবার পান পাগল। কিছু না কিছু নিয়ে আমরা প্রত্যেকে পাগলের মত ছুটে বেড়াচ্ছি। থামবো কবে? প্রসঙ্গ জানতে এখানে ক্লিক করুন

বিজ্ঞান শিক্ষার পরিবর্তে ধর্মশিক্ষার প্রচলন ও তার পরিণতি

দেশের বড় বড় বিজ্ঞান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেভাবে বেদ ও পুরাণসহ ধর্মশাস্ত্র পড়ানোর ধুম লেগেছে তাতে ভারতবর্ষ খুব তাড়াতাড়ি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মত অশিক্ষার কানাগলিতে ঢুকে যাবে। এভাবে চলতে থাকলে,বলা ভালো যেতে বাধ্য হবে। শিবপুর আই আই ই এস টি তে যেভাবে বেদ ও পুরাণ ভিত্তিক কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে তাতে এই আশঙ্কা প্রকট হয়ে উঠছে। সেই সঙ্গে গোলওয়ালকরের ছবি ও বই রেখে যেভাবে বিচ্ছিন্নতা ও সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন মতাদর্শকে হাইলাইট করা হচ্ছে তাতে ভারতের ভবিষ্যত দুর্দশার রূপটি স্পস্ট হয়ে উঠছে। বিস্তারিত পড়তে এখানে ক্লিক করুন ফেসবুকে দেখুন এখানে ক্লিক করে