শিক্ষা ও সততার সম্পর্ক
শিক্ষার গুরুত্ব
আপনি যত শিক্ষিত হয়ে উঠবেন, ততই আপনি সৎ হয়ে উঠবেন; হয়ে উঠবেন মানবতাবাদী। ঠিক এর উল্টোটার মতই। অর্থাৎ আপনার মধ্যে সততা এবং মানবতাবোধ যত কম, আপনি ততই অশিক্ষিত। হ্যাঁ, লেখাপড়া জানা ডিগ্রিধারী অশিক্ষিত। কারণ, শিক্ষার সঙ্গে সততার সম্পর্ক ইতিবাচক এবং সমানুপাতিক। ঠিক তেমনি, শিক্ষার সঙ্গে অসততার সম্পর্ক নেতিবাচক এবং ব্যস্তানুপাতিক। কেন?
আসলে জগত এবং জীবনের রহস্য যত উদঘাটিত হবে আপনার বা আমার কাছে, আমরা ততই দেখতে পাবো আমরা সবাই পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক। কারণ, প্রকৃতি বা ঈশ্বর যেভাবেই আপনি ভাবুন, দেখবেন তিনি এই জগৎ ও জীবনের নিরাপত্তা বিধানের জন্য একটা বিকল্পহীন সূত্র ব্যবহার করেছেন। সেই সূত্রের মূল কথা হল, প্রত্যেকটি জীব পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক। উদ্ভিদ জগৎ ভিন্ন যেমন প্রাণীজগৎ অচল, প্রাণীজগৎ ভিন্ন উদ্ভিদজগৎও ঠিক ততটাই অচল।
এই যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার নিয়ম, তা অর্জনই শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জন এবং উপলব্ধি করার জন্যই আমরা লেখাপড়া করি, স্কুল-কলেজে যাই। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, আমরা প্রকৃত শিক্ষিত হয়ে উঠতে পারি না। প্রকৃত শিক্ষা অর্জন আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে ওঠে না। আমাদের কাছে শিক্ষা মানে কিছু তত্ত্ব ও তথ্য মুখস্ত করা এবং তা খাতায় উগরে দিয়ে ভালো নম্বর পাওয়ার চেষ্টা করা। নম্বর পেলেই আমরা ভাবি আমরা সফল এবং শিক্ষিত। এই শিক্ষা শেষে উপলব্ধি কী হল, জগৎ ও জীবন পরিচালনার মূল সূত্র উপলব্ধি করতে পারলাম কি পারলাম না, সেটা ধর্তব্যের মধ্যেই আসে না। রবীন্দ্রনাথের তোতাপাখির মত আমাদের মাথার মধ্যে জ্ঞান গিজগিজ করে কিন্তু কোন কাজে লাগানো যায় না। তাই বেঁচে থাকার জন্য আমরা বিকল্প পথ খুঁজি। কীভাবে ফাঁকি দেব, ঘুষ দিয়ে কীভাবে অবৈধ পথে কাজ হাসিল করব, সুস্থ প্রতিযোগিতা নয়, ষড়যন্ত্র করে, অন্যের ক্ষতি করে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করব, সেটারই আপ্রাণ চেষ্টা করি। ঘুষ দিয়ে কিংবা গায়ের জোর খাটিয়ে, নিয়ম ভেঙে কাজ হাসিলের এই চেষ্টাকে বুক ফুলিয়ে গর্ব করে উপস্থাপন করাকে কৃতিত্ব বলে ভাবি। এতে আমাদের লজ্জা হয় না, লাগেনা ভয়ও। ঈশ্বর নামক সত্তার কাছে প্রার্থনা এবং ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমে সব পাপ থেকে মুক্ত হওয়ার রাস্তায় হাঁটি। এটাকেই প্রকৃত রাস্তা বলে চিন্তামুক্ত মনে ভাবতে শিখি। এবং গর্ব করে দাবি করি আমি ধার্মিক, আমি ধর্ম পালন করি।
এই শিক্ষাই কী প্রকৃত শিক্ষা। মুখে বলি, না। কিন্তু কাজের সময় নির্দ্বিধায় এটাকেই প্রকৃত শিক্ষা বলে মানি এবং তাকেই নিপুণভাবে কাজে লাগাই। সুতরাং এ শিক্ষা প্রকৃত শিক্ষা নয়। রবীন্দ্রনাথের কথায় শিক্ষা হল বহনকারী স্বত্তা, আমরা তার বহন। কিন্তু বাস্তবে দেখি ঠিক এর উল্টো। সার্টিফিকেট বয়ে বেড়াতে বেড়াতে জীবন কাটিয়ে দেই। তাকে বাহন করা আর হয়ে ওঠে না।
যদি আপনার মধ্যে এই প্রকৃত শিক্ষা একবার শিকড় গাড়তে পারে আপনার পক্ষে অন্যায় এবং অমানবিক কাজ করা আর কখনোই সম্ভব নয়। আপনার দ্বারা কখনোই কোন মানুষের কোনও রকমের ক্ষতি সাধন করা সম্ভব নয়। একমাত্র আত্মরক্ষা (প্রাণ সংশয়ের আশঙ্কা) ছাড়া ওই পথে আপনি হাঁটতে পারবেন না। কারণ, প্রকৃত শিক্ষা অর্জনের কল্যাণে আপনি বুঝে ফেলবেন, কোন অন্যায় কাজ আপনাকে কখনও কোনভাবে নিরাপত্তা দিতে পারেনা। নিরাপত্তার গ্যারান্টি পারস্পরিক সহযোগিতার মধ্য দিয়েই আসে। এই সহযোগিতার সূত্র ধরেই এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তৈরি। এই সূত্রকেই বলা হয় প্রাকৃতিক নিয়ম। এই নিয়ম ভাঙলেই বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। এই নিয়ম অংকের মত সূত্রে বাঁধা। এক চুল এদিক-ওদিক হলে যেমন অংক মেলেনা, তেমনি জগত সংসারের সব সম্পর্ক ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। এর থেকেই তৈরি হয় সন্দেহ এবং শত্রুতা। সততা হল এই পরিস্থিতি থেকে বেরনের ট্যাগলাইন এবং অদ্বিতীয় হাতিয়ার।
আপনি একশ ইট পরপর দাঁড় করিয়ে দিন গোল করে। দেখবেন বাইরে থেকে কেউ একটা ইটে আঘাত না করলে সেই ইটগুলো ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। ঈশ্বরের বিশ্বাসী হলে, বলতে পারেন ঈশ্বরের বিধান। আবার এই বিধান যদি একবার ভাঙে, অর্থাৎ একটা ইট ভাঙ্গে কোন পারিপার্শ্বিক চাপে, তবে পরবর্তী ৯৯ টি ইটের উপর তার প্রভাব পড়ে। একটা ইট আর একটাকে এবং সে তার পরেরটাকে ভেঙে দিতে বাধ্য হয়। সুতরাং এভাবে আপনার একটি অন্যায় অগুন্তি অন্যায়ের জন্ম দেবে, আপনার অজান্তেই। এবং একসময় সেই আঘাত আপনার ঘাড়ে এসেও পড়বে। পড়বেই, ওই গোল হয়ে থাকা ইটের অবস্থানের কারণে। আমরা সবাই প্রকৃতিতে ওই গোল হয়ে থাকা ইটগুলোর মত পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল ও পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত, এই গোলাকৃতির পৃথিবীতে।
বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বা প্রকৃতি এই নিয়মের বন্ধনে নিষ্ঠার সঙ্গে আবদ্ধ থেকে পথ চলছে। এই চলার মধ্যে ভাঙ্গা যেমন আছে, তেমনি আছে গড়া। এই ভাঙ্গা গড়া মানে বিপর্যয় নয়। এক প্রজন্ম শেষ হয়ে, আর এক প্রজন্মের দায়িত্বে বহাল হওয়া। বিপর্যয় আসে তখনই, যখন কোন অসৎ উদ্দেশ্যে প্রকৃতির এই নিয়ম ভাঙ্গা হয়। প্রকৃতির এই নিয়ম ভাঙ্গে তারাই, যারা প্রকৃতির এই নিয়ম সম্পর্কে সম্যক শিক্ষা অর্জন করতে পারেননি। এই নিয়ম ভাঙ্গার কারিগর কিছু মানুষ। আর যে অপশক্তি তাকে শক্তি যোগায়, তা হল তার লোভ এবং মোহ। এরাই প্রকৃত অর্থে শয়তান, যে আপনাকে নিয়ম ভাঙতে প্ররোচিত করে।
এই শয়তানকে মারতে হলে বা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে চাই প্রকৃত শিক্ষা। জগৎ ও জীবন পরিচালিত হচ্ছে যে নিয়মের বন্ধনে সে সম্পর্কে সম্যক উপলব্ধি। পৃথিবীতে আসার পর আপনি যদি এই নিয়ম সম্পর্কে অবহিত না হতে পারেন, আপনার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যত শক্তিশালী হোক না কেন, আপনি অশিক্ষিতই থেকে যাবেন। এবং এই অশিক্ষার ফাঁক গলে শয়তান এসে টুক করে ঢুকে পড়বে আপনার চেতনায়। ঠোকা দেবে এবং আপনি তার প্রভাবে বেরিয়ে এসে আপনার চারপাশে থাকা অসংখ্য ইটকে (মানুষ সহ সমস্ত প্রকৃতিতে থাকা বিষয় ও বস্তু কে) সেই ঠোকা খাওয়ার মত পরিবেশ তৈরি করে ফেলবেন। এবং এক-এক করে সবাই এই বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবেন। এখান থেকেই জন্ম নেবে পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস। এই অবিশ্বাস পরিণত হবে শত্রুতায়। এই শত্রুতা ছড়িয়ে পড়বে সমস্ত শিক্ষাহীন মানুষের মধ্যে। সমাজে নেমে আসবে হিংসা, যা বিপর্যয় ডেকে আনে।
প্রকৃত শিক্ষাই পারে একমাত্র মানুষকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে। এ শিক্ষা সেই শিক্ষা, যা পারস্পরের উপর নির্ভরশীলতা ও সহযোগিতার কথা বলে। বলে, এর কোন বিকল্প নেই।
--------xx-------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন