ভর্তুকি, কে কাকে দেয়?
ভর্তুকি দেওয়ার কারণ
ভর্তুকি কেন দেওয়া হয়, কাদের দেওয়া হয়, দেওয়া উচিৎ কিনা — এমন একাধিক প্রশ্ন আম জনতার মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে। কেউ এর পক্ষে, কেউ আবার বিপক্ষে।
সাধারণ মানুষের সহজ উত্তর হল, সরকার শ্রমজীবী মানুষকে দেয়। প্রশ্ন তোলা হয়, এভাবে কি একটা দেশ চলে? একটা সমাজ চলে? উত্তর হল, না।
কিন্তু এর পরের প্রশ্ন হল, এই ভর্তুকি দিতে হয় কেন? দিতে হয় তার কারণ, শ্রমজীবী মানুষের শ্রমের ন্যায্য ভাগ, তাদের দেওয়া হয় না। না দেওয়ার কারণে, দুটো ঘটনা ঘটতে পারে :
১) ন্যায্য ভাগ না পাওয়ার ক্ষোভ বিদ্রোহ আকারে ফেটে পড়তে পারে। অথবা,
২) অর্ধাহারে এবং অনাহারে থাকার কারণে অপুষ্টিতে ভুগে শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে অকাল মৃত্যু মহামারীর আকার নিতে পারে।
এই দুটো ঘটনাই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। একদিকে যেমন সস্তায় শ্রম পাওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে এবং অন্যদিকে তেমনি এর অভিঘাতে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে।
এই দুটো ঘটনার কোনটাই তাই পুঁজিবাদী শাসকদের কাছে কাম্য নয়। এ কারণেই তারা ভর্তুকের বিরুদ্ধে গলা তুললেও, ভর্তুকীর ব্যবস্থাকে তারাই সুকৌশলে টিকিয়ে রাখে।
আসলে ভর্তুকি হল পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার একটি টিকাকরণ প্রক্রিয়া। অপুষ্টিতে বোকা মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলার জন্য যেমন স্বল্পমাত্রায় জীবাণু ঢুকিয়ে দিয়ে ওই জীবাণুর বিরুদ্ধে তার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলা হয়, ভর্তুকি হল তেমনই একটি সহজ উপায়, যা দিয়ে শোষিত মানুষের বিদ্রোহ করার প্রবণতাকে অল্প খরচে রুখে দেয়া যায়।
প্রত্যেক শ্রমজীবী মানুষের উৎপাদনের ন্যায্য ভাগ দিলে কাউকে কোন ভর্তুকি দেওয়া লাগে না।
এ পৃথিবীর সমস্ত সম্পদের সৃষ্টিকর্তা হচ্ছেন শ্রমজীবী মানুষ। আর এই সম্পদের কাঁচামাল হল ঈশ্বরের সৃষ্টি। যারা বিশ্বাসী নয়, তাদের কাছে এই ঈশ্বর হচ্ছেন প্রকৃতি।
এই প্রকৃতি বা ঈশ্বর কি কখনো বলেছেন, এই কাঁচামালকে যারা সম্পদের রূপান্তরিত করবে, তারা তার প্রকৃত মালিকানা পাবে না? বলেননি। উল্টে শ্রমজীবী মানুষকেই তিনি দিয়েছেন সেই মেধা যা তার চারপাশে ছড়িয়ে থাকা প্রকৃতির উপাদানকে (কাঁচামালকে) সে সম্পদের রূপান্তরিত করতে পারে।
তাহলে সম্পদের প্রকৃত মালিকানা কার? যে বৈধ বা অবৈধ উপায়ে রাষ্ট্রীয় শক্তির সহযোগিতায় অঢেল মূল্যহীন কাগজের নোট (টাকা) জমা করেছেন তার, না যে কাঁচামালকে সম্পদের রূপান্তরিত করে তার। এটাই প্রাকৃতিক বা ঈশ্বরের নিয়ম। এই নিয়ম অমান্য করে যখন শ্রমজীবী মানুষের শ্রমের ন্যায্য মূল্য না দিয়ে, তাকে বঞ্চিত করে রাখা হয়, তখনই ভর্তুকি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে।
সুতরাং ভর্তুকি দেয়া সমস্যার সমাধান নয়। এটাকে যদি চিরতরে তুলতে হয় তবে সম্পদের সম বন্টন প্রয়োজন। করা হবে না, ততদিন এই ভর্তুকি দিয়ে যেতে হবে। মজার কথা হল রাষ্ট্রশক্তি যার নিয়ন্ত্রণে, সে এর বিরোধিতা করলেও, এটা দিতেই সে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কারণ, বঞ্চনার ইতিহাসকে ঢেকে দেয়ার এক অভিনব ও কার্যকর কৌশল।
কারণ, রাষ্ট্র শক্তির ধারক এবং বাহকরা রাষ্ট্রশক্তিকে শ্রমজীবী মানুষের শ্রমকে শোষন করার অবৈধ কাজকে বৈধ করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। সেই হাতিয়ারের নাম রাষ্ট্রীয় আইন। যারা আইন করে শোষন করে, আইন করে তারাই ভর্তুকি দেওয়ার ব্যবস্থা রাখে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন