সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বিশ্বাস, সংস্কার, কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও বিজ্ঞান

বিশ্বাস, সংস্কার, কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও বিজ্ঞান

ঈশ্বর আছেন। এটা এক ধরনের বিশ্বাস। এটা এমন এক বিশ্বাস যা প্রাথমিক ও অদ্বিতীয়। বাকি সব বিশ্বাসের মধ্যে আছে এমন বিশ্বাস, যা মানলে ক্ষতি নেই। তা হল  সংস্কার। অন্যদিকে এমন কিছু বিশ্বাস আছে, যা মানলে ক্ষতি হয়। এগুলো আসলে কুসংস্কার। ক্ষতি হবে জেনেও যদি তা মানা হয়, তাহলে তা অন্ধবিশ্বাস। আর প্রাথমিক বিশ্বাসের ভিত্তিকে যখন যুক্তি, বুদ্ধি ও তথ্য দিয়ে খোঁজার চেষ্টা হয় এবং কার্যকারণ সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে তাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা হয়, তখন তা হল বিজ্ঞান।

অধিকাংশ মানুষই বিশ্বাস করেন, ঈশ্বর আছেন। তিনিই সমস্ত কিছুর সৃষ্টিকর্তা। এতে সমস্যা নেই। এই বিশ্বাসকে সামনে রেখে যদি যুক্তি, বুদ্ধি ও তথ্য দিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করে এগোনো যায়, তবে যে সত্য সামনে আসে, তা হল এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত কিছুই কিছু নির্দিষ্ট নিয়মের বাঁধনে বাঁধা আছে। সূর্য ওঠা থেকে অস্ত যাওয়া, ঋতু পরিবর্তন হওয়া, গাছের পাতা নড়া, মাথার উপর ঘুরতে থাকা ফ্যানটি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়া — এমন সমস্ত কিছুই নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম কানুন দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে, যার ব্যতিক্রম হয় না এবং এই নিয়মগুলো কার্যকারণ সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।

কে গড়ে তুলেছেন এই নিয়ম, সমস্ত কিছুকে বেঁধেছেন নিয়মের বাঁধনে? যিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন, তাঁর মতে তিনি ঈশ্বর, আল্লাহ বা ভগবান। আর অবিশ্বাসীরা বলেন, প্রকৃতি। যে যে-নামেই ডাকুন না কেন, একটি সত্তা যে আছে, তা কেউই অস্বীকার করছেন না। বিজ্ঞান এই সৃষ্টিকর্তাকে খুঁজতে গিয়ে এমন এক সত্তার খোঁজ পেয়েছে, যাকে সে নাম দিয়েছে ‘ঈশ্বর কণা’ বা ‘গড পাটিকেল’। পদার্থ বিজ্ঞানের বইতে যাকে ‘হিগস্ বোসন কণা’ নামে খুঁজে পাওয়া যায়। অর্থাৎ বিজ্ঞানও আসলে সেই ‘সর্বশক্তিমান ঈশ্বর’কেই খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু সেই খোঁজার পিছনে রয়েছে যুক্তি, বুদ্ধি ও তথ্যের সমন্বয়ে গঠিত এমন একটি প্রক্রিয়া, যাকে আমরা বলি পরীক্ষণপর্যবেক্ষণ; যা বাঁধা আছে কার্যকারণ সম্পর্কের বাঁধনে। এখানে বিশ্বাস (প্রাথমিক) আছে, কিন্তু নেই সংস্কার, কুসংস্কার কিংবা অন্ধবিশ্বাস।

কিন্তু সমস্যা হল, যে ঈশ্বর সমস্ত কিছুকেই নির্দিষ্ট নিয়মের বাঁধনে বেঁধে পরিচালনা করছেন, তাঁকে খোঁজার জন্য কিংবা খুশি করার জন্য, আমরা যুক্তি তর্কের ধার ধারি না। সমস্ত কিছু ঘটার পেছনে কারণ হিসেবে আমরা খুঁজে বেড়াই এমন কিছু বিধি-বিধান, যা যুক্তি, বুদ্ধি বা তথ্যের মানদন্ডে প্রমাণ করা যায় না। মেনে চলি এমন কিছু আচার বিচার বা পালন করি এমন সব আচার-অনুষ্ঠান, কার্যকারণ সম্পর্কের ভিতরে যাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। মজার কথা হল, আমরা তার কোন প্রয়োজনও বোধ করি না। বলা হয়, বিশ্বাসই সেখানে মূল মানদণ্ড। এই বিশ্বাস আসলে এক ধরনের সংস্কার, যা কিছু সুবিধাবাদী (সুবিধাভোগী) মানুষ ঈশ্বরের নামে মানুষের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। এখানে ‘প্রকৃত ঈশ্বর’ নেই। 

আমরা বিশ্বাস করি, ঈশ্বরের বিধান ছাড়া কোন কিছুই ঘটে না। অথচ সেই ঈশ্বরকে পাওয়ার জন্য আমরা অবলীলায় ঈশ্বরের তৈরি জগৎ ও জীবনের সমস্ত বিধানকে ভেঙে ফেলি। পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করার জন্য সরস্বতীর পূজা করি কিংবা খাতার পাতায় গদগদ হয়ে লিখি ‘এলাহি ভরসা’। অথচ ঈশ্বরের বিধান হল, বুঝে বুঝে জগত এবং জীবন সম্পর্কে তাঁর তৈরি বিধানগুলি, যা বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রকাশিত হয়েছে, তা অনুসরণ করলেই কেবল ভালো রেজাল্ট করা সম্ভব। আমাদের মাথায় এই যুক্তিবোধ কাজ করে না যে, সরস্বতী ঠাকুরের পূজা করার মধ্য দিয়েই যদি একমাত্র ভালো রেজাল্ট করা সম্ভব হয়, তাহলে যারা এই পূজা করেন না, তারা কীভাবে ভালো রেজাল্ট করেন? অন্যদিকে, যারা খাতার মাথায় এলাহি ভরসা লিখছেন না, তারাই বা কীভাবে ভালো রেজাল্ট করছেন?

আসলে আমাদের বিশ্বাস আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। সমাজপতি কিংবা রাজনীতিকরা মানুষ জন্মানোর পরপরই তার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এই নিয়ন্ত্রণ আসে প্রাথমিক পর্যায়ে পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের কাছ থেকে, যারা আসলে কিছু সুবিধাবাদী মানুষের কাছে তার নানাবিধ সমস্যায় সুরাহা খোঁজার তাগিদে আত্মসমর্পণ করে বসে আছেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে মানুষের মগজের নিয়ন্ত্রণ নেয় রাজনীতিকরা। কারণ, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের মোড়কে তারা জনগণের মধ্যে সাড়ম্বরে ঢুকিয়ে দেয় সংস্কার, কুসংস্কার এবং সর্বোপরি অন্ধবিশ্বাসকে। কারণ, এই অন্ধবিশ্বাস এমন এক অস্ত্র, যা জনগণের সমর্থন আদায়ের প্রচন্ড শক্তিশালী ভূমিকা নেয়। সুবিধাভোগীর অনায্য সুবিধা আদায়ের ন্যায্যতা দিতে এই অন্ধবিশ্বাস খুবই কার্যকর, যেখানে বলা হয়, বোঝানো হয়, তোমার ভাগ্যের নিয়ন্ত্রণ তোমার হাতে নেই, আছে ঈশ্বর নামক এক সর্বশক্তিমান সত্তার উপর। পূজা অর্চনা, কিংবা উপাসনার মাধ্যমে কেবলমাত্র এই অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে। জ্ঞানের আলোকশিখা পড়েনি যার চেতনায়, খোলেনি যার তৃতীয় নয়ন (ইতিহাস চেতনা), সে সহজেই এই উপায়কে একমাত্র বলে স্বীকার করে নেয় এবং শাসকের অনুগত থাকার অঙ্গীকার করে।

অথচ মানুষ জন্মসূত্রে যুক্তিবাদী ও কার্যকারণ সম্পর্কে বিশ্বাসী। 

মন্তব্যসমূহ

আলী হোসেনের বহুল-পঠিত উক্তিগুলো পড়ুন

ধর্মের নামে রাজনীতিই প্রমাণ করে আমরা মধ্যযুগীয়

ধর্মের নামে রাজনীতিই প্রমাণ করে আমরা মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষে এখনও যে ধর্মের নামে রাজনীতি হয় বা হচ্ছে, তাতেই প্রমাণ হয় আমরা আধুনিক নয়, চিন্তায়-চেতনায় এখনো মধ্যযুগে বাস করি। কারণ, আধুনিক যুগের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য আছে। কোন জাতি, নিজেকে আধুনিক বলে দাবি করতে চাইলে, এই বৈশিষ্ট্যগুলো তাদের মধ্যে থাকা প্রয়োজন। এর মধ্যে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো হল ধর্ম-মুক্ত রাজনীতি। পৃথিবীর যেখানে যেখানে রাজনীতি ধর্মমুক্ত হয়েছে, সেখানে সেখানে রাজনৈতিক হিংসা হানাহানি অনেক কমে গেছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা, যা আধুনিকতার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর দিকে তাকালেই বুঝতে পারা যায় ধর্মের সঙ্গে রাজনীতি সম্পর্কিত থাকলে কি ভয়ংকর রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়। বোঝা যায়, কীভাবে নিরবিচ্ছিন্ন অস্থিরতা ও রাজনৈতিক হিংসা এবং প্রতিহিংসার দাপটে একটা জাতি শতধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। মূলত এ কারণেই, অসংখ্য ছোট ছোট, বলা ভালো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়েছে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য। ফলে সাম্রাজ্যবাদী বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর নয়া সাম্রাজ্যবাদী নাগপাশ ...

ধর্ম দিয়ে ধর্মান্ধতা দূর করা যায় না।

ধর্ম দিয়ে ধর্মান্ধতা দূর করা যায় না। কারণ দুটোরই ভিত্তি হচ্ছে যুক্তিবিমুখ বিশ্বাস। তাই, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা হয়তো যায়। কিন্তু ধর্ম দিয়ে ধর্মান্ধতা দূর করা কখনই যায় না। একথা ভুলতে বসেছেন যাঁরা, তাঁরা নিজেদের প্রগতিশীল দাবি করতেই পারেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এতে প্রগতিশীলতা গতিলাভ করে না বরং গতি হারায়। --------x------- Di Ansar Ali হ্যা, পরিস্থিতি অনুযায়ী সমঝোতা করতে হয়। কিন্তু মাথায় রাখতে হয়, তাতে আমার সত্যিই কোনো লাভ হচ্ছে কিনা। এবং তার অদূর ও সুদূরপ্রসারী ফলাফল প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করাটা মোটেই যুক্তিযুক্ত নয় বলেই মনে হয়। কারণ, তাতে পরের যাত্রা হয়তো ভঙ্গ হয়, কিন্তু নিজের শরীরে ভয়ঙ্কর ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়ার দখলদারি বেড়ে যেতে পারে। আমার মনে হয়, এই হিসাবটা ঠিকঠাক না করতে পারলে পরিস্থিতি অনুকূলে আসার পরিবর্তে প্রতিকূলে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। এক্ষেত্রে 'দশচক্রে ভগবান ভুত হওয়ার' বিষয়টিও মাথায় রাখার প্রয়োজন খুব বেশি বলেই আমি মনে করি। যারা প্রগতিশীল নয়, বলে এতদিন বলে আসছি তারা যদি হঠাৎ করে প্রগতিশীল হয়ে ওঠে তবে, ...

বিজেপি ও আরএসএস কি আলাদা?

বিজেপি ও আরএসএস কি আলাদা? বিজেপি ও আরএসএস-এর রসায়ন সম্পর্কে সম্যক অবহিত আছেন, এমন মানুষদের সবাই জানেন বিজেপির সঙ্গে আরএসএস-এর গভীর সম্পর্কের কথা। এবং তাঁরা এটাও জানেন যে, আরএসএস দ্বারা বিজেপি নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। তাই এই দুই সংগঠনকে আপাতদৃষ্টিতে আলাদা মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এরা আলাদা নয়। বরং এরা একে অপরের পরিপূরক। বিস্তারিত দেখুন এখানে ক্লিক করে

ইতিহাস কী?

ইতিহাস কী? ইতিহাস হচ্ছে মানুষের তৃতীয় নয়ন। এই তৃতীয় নয়ন মানুষকে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ বিষয়ে সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করতে সাহায্য করে। এই পর্যবেক্ষণই জগত এবং জীবনের প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। একজন মানুষ, জগত ও জীবন সম্পর্কে  প্রকৃত সত্য যতটা উপলব্ধি করতে পারেন, তিনি ততটাই শিক্ষিত বলে বিবেচিত হন। তাই ইতিহাস জানা এবং বোঝা ছাড়া একজন মানুষ পূর্ণাঙ্গ শিক্ষিত হয়ে উঠতে পারেন না। ইতিহাস কেন তৃতীয় নয়ন? একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথা ধরুন। আমরা এই ঘটনাকে যখন প্রত্যক্ষ করি, তখন দেখি দুটি ভিন্ন ধর্মের মানুষ পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে সহিংস হয়ে উঠছে। আমরা খুব সহজেই এই ঘটনাকে ধর্মের সঙ্গে জুড়ে দিই এবং ধর্মকে এর কারণ হিসেবে চিহ্নিত করি। ধর্মীয় বিদ্বেষের ফল হিসেবে সেগুলোকে ব্যাখ্যা করি। কিন্তু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ইতিহাসকে কার্যকারণ সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, এই দাঙ্গাগুলোর পিছনে ধর্মের চেয়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য খুবই শক্তিশালী ভূমিকায় রয়েছে। অর্থাৎ মূলত, ...

বিজ্ঞান শিক্ষার পরিবর্তে ধর্মশিক্ষার প্রচলন ও তার পরিণতি

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্ম শিক্ষার প্রভাব দেশের বড় বড় বিজ্ঞান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেভাবে বেদ ও পুরাণসহ ধর্মশাস্ত্র পড়ানোর ধুম লেগেছে তাতে ভারতবর্ষ খুব তাড়াতাড়ি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মত অশিক্ষার কানাগলিতে ঢুকে যাবে। এভাবে চলতে থাকলে,বলা ভালো যেতে বাধ্য হবে। শিবপুর আই আই ই এস টি তে যেভাবে বেদ ও পুরাণ ভিত্তিক কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে তাতে এই আশঙ্কা প্রকট হয়ে উঠছে। সেই সঙ্গে গোলওয়ালকরের ছবি ও বই রেখে যেভাবে বিচ্ছিন্নতা ও সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন মতাদর্শকে হাইলাইট করা হচ্ছে তাতে ভারতের ভবিষ্যত দুর্দশার রূপটি স্পস্ট হয়ে উঠছে। বিস্তারিত পড়তে এখানে ক্লিক করুন ফেসবুকে দেখুন এখানে ক্লিক করে