নারীবাদ কী? নারীবাদী হওয়া কী যৌক্তিক?
নারীবাদ, কোন বিশ্বাস নয়, এটা একটা ধারণা বা মতবাদ। এই মতবাদ অনুসারে, একজন নারী একজন মানুষ হিসাবে ‘পূর্ণ মানবিক অধিকার ও মর্যাদা’ দাবি করে। অর্থাৎ একজন নারী তার অর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে লিঙ্গ ভেদে সমতার দাবি করে।
এই মতবাদের ওপর ভিত্তি করে প্রথমে ইউরোপে এবং ক্রমশ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছে তা ‘নারী আন্দোলন’ নামে পরিচিতি। মূলত আধুনিক ইউরোপীয় চিন্তাধারা থেকে এই আন্দোলনের উৎপত্তি।
খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দীতে রোমান রাষ্ট্রনায়ক মার্কাস পোরসিয়াস ক্যাটো নারীদের ব্যয়বহুল পণ্য ব্যবহার সীমিত করার জন্য একটি আইন করার চেষ্টা করলে, রোমান মহিলারা ক্যাপিটোলিন হিল (রাষ্টনেতার দূর্গ) অবরোধ করেন। এই ঘটনায় ক্যাটো আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, এবং কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “যদি তারা আপনার সমান হতে শুরু করে, তারা আপনার ঊর্ধ্বতন হয়ে উঠবে।” (As soon as they begin to be your equals, they will have become your superiors.” —Encyclopædia Britannica)
১৪ শতকের শেষ এবং ১৫ শতকের প্রথম দিকে ফ্রান্সে, প্রথম নারীবাদী দার্শনিক, ক্রিস্টিন ডি পিসান, নারী শিক্ষার জন্য সাহসী আহ্বান জানিয়ে মহিলাদের প্রতি বিদ্যমান মনোভাবকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। ১৫ শতকের একজন ভেনিসিয়ান মহিলা যিনি প্রকাশ করেছিলেন ‘Collected Letters of a Renaissance Feminist’. এই গ্রন্থে নারীদের শিক্ষা অস্বীকার এবং বৈবাহিক নিপীড়ন থেকে শুরু করে নারীর পোশাকের তুচ্ছতা বিষয়ে অভিযোগ করা হয়েছে।সমাজে পুরুষতান্ত্রিকতা আছে। ভীষণভাবেই আছে। তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জরুরি। কিন্তু সেটা ‘নারীবাদী’ হয়ে নয়, মানবতাবাদী হয়ে। কারণ, পৃথিবীতে এই একটাই ইজম আছে যার বিরোধিতা করার, বা তাকে বৈষম্যের পক্ষে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার কোন সুযোগ নেই। এর বাইরে, এক ইজম আর এক ইজমের জন্ম দিতে পারে সহজেই।
‘নারীবাদী’ শব্দটার প্রচার ও প্রসার ঘটলে পুরুষতন্ত্রের হাতে তা বাড়তি একটা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ বাড়ে। আর এটা যে হচ্ছে, তার দৃষ্টান্ত হিসেবে রেবেকা ওয়েস্টের একটি মন্তব্য উল্লেখ করা যায়। তিনি লিখছেন,
“নারীবাদ কী, নিজে বুঝিনি। কিন্তু পাপোশ না হয়ে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করলেই লোকে আমাকে নারীবাদী বলেছে।”
ফলে মানুষ হিসাবে নারীর সমান-অধিকারের আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ‘নারী স্বাধীনতা’ অধরাই থেকে যাবে।
এখন প্রশ্ন হল, নারী স্বাধীনতার অর্থ কী? স্বাধীনতা মানে, যা-ইচ্ছা-তাই করা নয়। যা-ইচ্ছা-তাই করার অর্থ হল, স্বেচ্ছাচারিতা। স্বাধীনতার ও স্বেচ্ছাচারিতা পরস্পর বিরোধী সত্তা। স্বাধীনতা মানে, নিজের মতামত প্রকাশের অধিকার, ন্যায্য দাবির প্রতি সকলের মান্যতার স্বীকৃতিসহ সম্মান ও মর্যাদার সামাজিক ও রাষ্ট্রিক স্বীকৃতি পাওয়া। এক কথায়, লিঙ্গভেদ সত্বেও সমানাধিকারের দাবির মান্যতা।
নারীর সমান অধিকারের কথা বললেই কেউ কেউ ভাবেন, নারী সমান অধিকার দাবি করবে কীভাবে? প্রকৃতি কিংবা ঈশ্বর তার সামর্থ্যকে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছেন। সন্তান ধারণের সময় সে একজন পুরুষ মানুষের মতো সমস্ত রকম কাজ করার ক্ষমতা কী রাখে?
রাখেনা— এ কথা সত্যি। কিন্তু এটা কোন সীমাবদ্ধতা নয়। এটা তার একটা বিশেষ সামর্থ্য, যা পুরুষ মানুষের নেই। এটা যদি সীমাবদ্ধতা হয়, তাহলে পুরুষের সন্তান ধারণের অক্ষমতাও এমনই এক সীমাবদ্ধতা হিসাবে বিবেচিত হবে। এ সীমাবদ্ধতা কি একজন পুরুষ স্বীকার করে? একজন পুরুষ যদি তা স্বীকার না করে, তবে কোন যুক্তিতে সন্তান ধারণের সময়কে ‘অক্ষমতার সময়’ হিসেবে পুরুষ চিহ্নিত করে?
আসলে প্রকৃতিগতভাবে, নারী এবং পুরুষের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। এই সীমাবদ্ধতার কোন নেতিবাচক দিক নেই। সমাজ ও সভ্যতার প্রয়োজনে এই সীমাবদ্ধতা থাকার প্রয়োজন রয়েছে। আসলে, ঈশ্বর বা প্রকৃতি যাই বলুন না কেন, তিনি নারী পুরুষের সমান অধিকারের, সমান মর্যাদার ও সম্মানের স্বার্থেই পরস্পরের মধ্যে এই সীমাবদ্ধতা রেখেছেন।
সুতরাং আপনি, যদি ঈশ্বরে বিশ্বাসী হন, আপনাকে মনে রাখতে হবে, ঈশ্বর নারী পুরুষের মধ্যে কোন বৈষম্য ও বিরোধ চাইছেন না। যদি প্রকৃতিবাদী হন, তাহলেও আপনাকে মানতে হবে, প্রকৃতি এই বৈষম্যের বিরোধী। পরিবেশকে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, সেখানে অবস্থিত প্রত্যেকটা জীব এবং অজৈব পদার্থ একে অপরের পরিপূরক। নারীর সন্তান ধারণের সক্ষমতা এবং একজন পুরুষের সন্তান ধারণের অক্ষমতা সেটাই প্রমাণ করে।
আপনি প্রশ্ন তুলতে পারেন, একজন নারী কি একা একাই সন্তান ধারণের সক্ষমতা রাখে? রাখে না। কিন্তু একজন পুরুষ হিসেবে আপনি কি রাখেন এই ক্ষমতা?
তাহলে, আমাদের সমাজে নারী পুরুষের মধ্যে বৈষম্য রাখাটা কীভাবে ধর্ম শাস্ত্রের নামে মান্যতা দেয়?
আসলে, ধর্মগ্রন্থগুলো যদি ঈশ্বরের বাণী হয়, তাহলে তার মধ্যে এই বৈষম্যের তত্ত্ব স্থান পাওয়ার কথা নয়। কারণ, ঈশ্বর তার সৃষ্টির মধ্য দিয়ে প্রতিপদে এই বৈষম্যকে অস্বীকার করেছেন। নারী পুরুষ উভয়কে পরস্পরের উপর নির্ভরশীল করে গড়ে তুলেছেন। এটা শুধু মানুষ নয়, প্রকৃতির প্রায় প্রতিটি জীবের ক্ষেত্রে এই নীতি অবলম্বিত হয়েছে। তাহলে বৈষম্যের কথা কোন কোন ধর্মগ্রন্থে আছে কেন? যুক্তি বলছে, হয় এখানে চতুর মানুষের হাত পড়েছে, না হয় তা ঈশ্বরের তৈরি নয়, মানুষের তৈরি।
প্রকৃতপক্ষে, ঈশ্বর কিংবা প্রকৃতি, যে নামেই আপনি তাকে অভিহিত করুন না কেন, তিনি আপনার জন্য এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে একটি পাঠশালা এবং কর্মশালা হিসাবে নির্মাণ করেছেন। সেখানেই রয়েছে বেঁচে থাকা ও ভালো থাকার বিধি-বিধান। আপনাকে চোখ কান খোলা রাখতে হবে, প্রকৃতি থেকেই পাঠ নিতে হবে শিক্ষার। কারণ, প্রকৃতির পাঠশালায় লিপিবদ্ধ আছে সেইসব নিয়ম-কানুন, যা প্রত্যেকটা জীবকে মেনে চলতে হয়। আমরা যাদের বিজ্ঞানী বলি, তারা এ কাজটাই করে চলেছেন দিন রাত এক করে। আবিষ্কার করে চলেছেন এক একটি নিয়ম।
মানুষের সমস্যা হল, তারা এই পাঠশালার পাঠ হয় নিতে অস্বীকার করে, নতুবা ক্ষুদ্র স্বার্থে তাকে এমন ভাবে মডিফাই করে ব্যবহার করে, যার থেকে জন্ম নেয় বৈষম্য। আর এই বৈষম্যের শিকার শুধু নারী নয়, পুরুষও। বৈষম্যকে টিকিয়ে রাখার জন্যেই মনুষ্য সমাজকে নানাভাবে বিভক্ত করে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেওয়ার কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে। এই লড়াইয়ের এক একটি রূপ একেক নামে অভিহিত হয়েছে। কখনো নারীতন্ত্রের বিরুদ্ধে পুরুষতন্ত্রের, সময়ের ব্যবধানে তা হয়ে উঠেছে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে নারী তন্ত্রের। জন্ম নিয়েছে শ্রমিক ও মালিক শ্রেণি। প্রসঙ্গত বলে রাখা দরকার, পৃথিবীতে প্রথম জন্ম নেওয়া সমাজ ছিল নারীতান্ত্রিক বা মাতৃতান্ত্রিক।
একজন নারীকে যদি তার অধিকারের দাবি করতে হয়, তবে তাকে লড়তে হবে, তবে তা কোন পুরুষের বিরুদ্ধে নয়, সমাজের সেই সব এলিমেন্টার বিরূদ্ধে, যারা এই বৈষম্যের ধারক ও বাহক। আর এই লড়াইয়ে জিততে হলে, পুরুষকে সহযোদ্ধা হিসাবে গ্রহণ করতে হবে। এবং এই সহযোগিতা পাওয়ার সক্ষমতা তাকে অর্জন করতে হবে। ‘নারীবাদী’ শব্দের ব্যবহার এই আন্দোলন ও সহযোগিতা পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে আসছে যুগ যুগ ধরে। এটাই বৈষম্য জিইয়ে রাখার কুশিলবদের হাতিয়ার হয়ে উঠছে বারবার। ফলে এই আন্দোলন ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’য় পর্যবসিত হয়েছে। তাই ‘নারীবাদ’ নয়, মানবতাবাদই হল অপেক্ষাকৃত উপযুক্ত মতবাদ, যা নারী-পুরুষসহ সমস্ত রকম বৈষম্য দূর করতে অপেক্ষাকৃত বেশি সহায়ক হতে পারে।
কীভাবে সম্ভব এই অর্জন? সম্ভব প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ওঠার মাধ্যমে। কারণ, এই শিক্ষাকে পাথেয় করেই একজন মানুষ (এখানে নারী) স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারে। আর্থিকভাবে কারও ওপর নির্ভরশীল হলে, সেই সামর্থ্য শুধু নারী নয়, কোন মানুষের পক্ষেই অর্জন করা সম্ভব হয় না।
সুতরাং সমাজের এই শৃংখল, যা বৈষম্যকে শক্ত হাতে ধরে রেখেছে, তার বিরুদ্ধে তাকে লড়তে হবে। প্রকৃত শিক্ষাই সেই অস্ত্র যা তাকে এই লড়ার সামর্থ্য এনে দেবে। তাই কোন নারীর, কোন পুরুষের প্রেমে পড়ার আগে, শিক্ষার প্রেমে পড়া উচিত। প্রত্যেক কন্যা সন্তানকে মনে রাখতে হবে, শিক্ষাই একমাত্র বন্ধু, যে কখনও প্রতিদান চায় না। মৃত্যুর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সে তোমাকে বাঁচতে সহায়তা দিয়ে যাবে।
লেখা চলছে...
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন