স্বামী বিবেকানন্দ। একটু গাঢ় গেরুয়া ( বিজেপির গেরুয়া নয়) রংয়ের বসন পরিহিত একজন সন্ন্যাসী। মানুক আর না মানুক, প্রায় সারা বিশ্বই তাঁকে চেনে।
তিনি কি বলেছেন?
তিনি বলেছেন, জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর। এই কথার মর্মবাণী কী? মানুষকে ভালোবাসো এবং মানুষের কল্যাণে কাজ কর। স্পষ্ট করে বলেছেন, সমাজে পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের ক্ষমতায়নের কথা। এবং একটি সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা। বলেছেন, এ ছাড়া ভারতের মুক্তি নেই।
এ ধরণের মনুষ্য সমাজ আর কারা দেখতে চেয়েছিলেন?
যীশু, হযরত মুহাম্মদ, কাল মার্কস, চন্ডীদাস, শ্রীচৈতন্য, আরো কত নাম আছে এই দলে। তাদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথ ভিন্ন হলেও, মত তো মোটামুটি এক।
এই ধরণর সমাজ কোন রাজনৈতিক দল গড়তে চান?
যারা নিজেদের বামপন্থী বলে দাবি করেন। কমিউনিস্ট বলে দাবি করেন। খুলে ঢেলে বললে, সিপিএম,সিপিআই,আর এস পি, এস ইউ সি আই, ফরোয়ার্ড ব্লক ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই ভাবনার বিরোধিতা কারা করেন?
দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো। কট্টরভাবে বিজেপি। যদিও বিজেপির সাধারণ সমর্থকদের অধিকাংশই এই বিরোধিতার কথা জানেন না। কারণ,তাদের জানানো হয় না। জানালে সাধারণ মানুষ আর বিজেপি করবে কিনা সন্দেহ আছে।
আমাদের সমাজে কি ঘটছে এখন?
সন্ন্যাসীর গেরুয়া পোশাক পরা ছবি ফ্রেমে বাঁধিয়ে, তাঁকে সামনে রেখে ফুল মালা চড়িয়ে কট্টর দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকরা মাইক বাজিয়ে স্বামীজীর যাঁরা অনুসারী এবং অনুগামী তাদের নিজের দলে টানার চেষ্টা করছে। আর সেখানে যা বলছেন, তার সাথে তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতির কোন মিল নেই। মানুষ আস্তে আস্তে বিশ্বাস করছে, স্বামী বিবেকানন্দ একজন হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রচিন্তাবিদ। এবিষয়ে তাদের বইও আছে। তাদের একটির নাম ‘স্বামীজীর হিন্দু রাষ্ট্রচিন্তা’।
যারা নিজেদেরকে বামপন্থী বলে দাবি করে, তারা এই গেরুয়া রং দেখেই বিবেকানন্দকে এড়িয়ে চলেন। কেন এড়িয়ে চলেন? যুক্তি হল, গেরুয়া রঙের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক রয়েছে। আর তিনি হিন্দুধর্মের পুনর্জাগরণ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাই এই গেরুয়া বসনধারী স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে বেশি চর্চা করলে বিজেপিই বেশি লাভবান হবে। তাই তারা চুপচাপ।
ফলে কি ঘটছে?
বিজেপি ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে যাচ্ছে? স্বামী বিবেকানন্দের বাণী, কখনো বিকৃত করে, কখনো আংশিক উদ্ধৃত করে এবং কিছু সত্য ও তার সঙ্গে অর্ধ-সত্য বা মিথ্যা মিশিয়ে ,তুলে ধরছে মানুষের মধ্যে। এভাবে জনমানষে স্বামীজিকে নিজেদের লোক বলে পরিচিত করাছে। বাস্তব হল আর এস এস ও বিজেপির আদর্শের সঙ্গে স্বামীজির আদর্শের কোন মিলই নেই। বলা যায় সম্পূর্ণ বিপরীত। নিশ্চয়ই এ এক ধরনের মিথ্যাচার। কিন্তু তারা তা করছে।
কিন্তু আমরা কি করছি? চুপচাপ বসে আছি। কারণ, ধর্ম আমাদের শত্রু। তাই তার সঙ্গে সংশ্রম আছে এমন মানুষকে ছোঁয়া যাবে না।
যদি না ছুই, তবে দক্ষিণপন্থীদের মিথ্যাচার ধরে দেবে কে? আসল সত্যিটা বলবে কে?
স্বামীজি যে সমাজ পরিবর্তনের কথা বলেছিলেন, শূদ্র সমাজের জাগরণের কথা বলেছিলেন, তা তাদের জানাবে কে? তারা কাকে সামনে রাখবে, যার মধ্যে একযোগে তাদের রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক আইডলকে দেখতে পাবেন?
ফল কি হচ্ছে?
১) স্বামীজীর নামে চালানো হিন্দু রাষ্ট্রচিন্তার মিথ্যা ব্যাখ্যা জন মানুষের মধ্যে ক্রমশ সত্য বলে প্রচারিত হচ্ছে।
২) এই মিথ্যাকে খণ্ডন করে স্বামীজীর সত্য ভাষণকে প্রতিষ্ঠা করার কাজ করা যাচ্ছে না।
৩) বামপন্থী মতাদর্শ ক্রমশক্তি হারাচ্ছে। স্বামী বিবেকানন্দকে ব্যবহার করলে যেটা আরও বেশি শক্তিশালী হওয়ার কথা ছিল,তা হচ্ছে না।
দক্ষিণপন্থীরা স্বামী বিবেকানন্দের সাম্যবাদী ভাবনাকে এড়িয়ে গিয়ে তার ধর্ম দর্শনের আংশিক এবং কখনো কখনো খন্ডিত অংশকে ব্যবহার করে নিজের রাজনৈতিক দর্শনকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করতে পারে, আর বামপন্থীরা তার লেখার পাতায় পাতায় যে খেটে খাওয়া মানুষের ক্ষমতায়নের কথা বলা রয়েছে, তার কথা উল্লেখ করতে পারবে না কেন? তা নিয়ে নিয়ে পথ সভা,সেমিনার, আলোচনা সভার আয়োজন করতে পারেন না কেন?মনে রাখা উচিত, নাচতে নেমে ঘোমটা দেওয়া সাজে না।
যদি না পারা যায়, তাহলে জনমানুষে বামপন্থা সম্পর্কে কি ধারণা জন্মাবে?
তিনটি সিদ্ধান্ত মানুষের অন্তরে উঠে আসতে পারে -
১) বামপন্থীরা আসলে আজ আর সত্যিকারের বামপন্থী নেই। তারা মেহনতি মানুষের ক্ষমতায়ন চান না।
২) যারা আছেন তারা বামপন্থার ভেক ধরে জনগণকে বিভ্রান্ত করে শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করছেন।
অথবা,
৩) স্বামী বিবেকানন্দের বাংলার সমাজ জীবনে বিশেষ করে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে কতটা প্রভাব আছে তা তারা জানেন না
৪) তৃতীয় আরও একটি হতে পারে, বামপন্থী নেতা-নেত্রীরা ভারতীয় রাজনীতির হৃদস্পন্দনটি আজও ধরতে পারেননি।
৫) অথবা নেতৃত্ব স্বামী বিবেকানন্দকে সেভাবে পড়েননি।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন