মনীষী কাদের বলে? মনীষীদের কীভাবে মূল্যায়ন করা উচিত
Md Riazuddin Gayen আপনি বলেছেন স্বামী বিবেকানন্দের মধ্যে স্ববিরোধী বক্তব্য আছে। কিন্তু আপনি কি জানেন, এই অভিযোগ পৃথিবীর সব মহাপুরুষ সম্পর্কে করা যায়? করা যায়, তার কারণ :
১) আমরা কোন মহাপুরুষকেই তার সম্পর্কে সামগ্রিক-পড়াশোনার মাধ্যমে তার সম্বন্ধে সিদ্ধান্তে আসিনা। কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের দেওয়া কিছু উদ্ধৃতি দিয়ে তাকে জানা বা চেনার চেষ্টা করি। মুশকিল হচ্ছে, এই উদ্ধৃতকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই তাকে উদ্ধৃত করেন। এই উদ্দেশ্য সৎ আবার অসৎ - দুই হতে পারে। অনেক সময় একটি সামগ্রিক বক্তব্যের মধ্য থেকে তার নিজের প্রয়োজনের অংশটুকুই তিনি উদ্ধৃত করেন এবং আগের ও পরের প্রাসঙ্গিক অংশটুকু বাদ দিয়ে দেন। এতে ওই মহাপুরুষের বক্তব্যের বিকৃতি ঘটে এবং উদ্ধৃতকারীর উদ্দেশ্য চরিতার্থ হয়।
এই ষড়যন্ত্র এবং কুচক্রের শিকার পৃথিবীর সব ধর্ম প্রবর্তক দার্শনিক, কবি, সাহিত্যিক, - এক কথায় সব মনীষীই। আমরা অধিকাংশ মানুষই এই ভুল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোন মনীষীর মূল্যায়ন করে থাকি। তাই তিনি পরস্পর বিরোধী বক্তব্যের বক্তা হিসেবে কারো কারো কাছে পরিচিতি পেয়ে যান।
২) দ্বিতীয় যে কারণে এমনটা মনে হয়, বা বলা ভালো ঘটে, তাহল, একজন মহাপুরুষের মহাপুরুষ হয়ে ওঠার যে কালপর্ব, সেই কালপর্বের মধ্যে ঘটে যাওয়া তার চিন্তা ও চেতনার পরিবর্তন বা বিবর্তন সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা। একজন মানুষ কখনোই মনীষী হয়ে জন্মান না, জন্মানোর পরই জগৎ ও জীবন সম্পর্কে গভীর চিন্তাভাবনা ও গবেষণার মধ্য দিয়ে তিনি একজন মনীষী হয়ে ওঠেন। এই মনীষী হয়ে ওঠার পিছনে থাকে তার ত্যাগ, তিতিক্ষা ও অধ্যাবসায়। সব মানুষ এই ধরনের সাধনায় নিজেকে নিমগ্ন করে রাখতে পারে না। বৈষয়িক স্বার্থ-ভাবনাই তার উচ্চতর সাধন-ভাবনার পথের কাটা হয়ে ওঠে। তাই সবাই মনীষী হয়ে উঠতে পারেন না। যারাই বৈষয়িক স্বার্থ-ভাবনার উর্ধ্বে উঠতে পারেন, তারাই মনীষী হয়ে ওঠেন।
আসলে একজন মানুষ জীবনের প্রথম ভাগে জগত ও জীবনকে যেভাবে দেখেছেন সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে সেই দেখা এবং উপলব্ধির মধ্যে পরিবর্তন কিম্বা বিবর্তন আসে। যত বয়স এবং অভিজ্ঞতা বাড়ে, জীবন ও জগৎকে তিনি আরও গভীরভাবে দেখার সুযোগ পান। এই সুযোগ যত পান, তত এই পরিবর্তন ও বিবর্তনগুলো প্রকট হয়ে ওঠে। এইভাবে আস্তে আস্তে এক সময় তিনি জগত ও জীবন সম্পর্কে প্রকৃত সত্যের মুখোমুখি হয়ে যান। তখনই তিনি মনীষী হিসেবে বিবেচিত হন।
আমরা যাকে মহানবী (হযরত মহম্মদ) বলি তার এই পর্বে পৌঁছাতে ৪০ বছর সময় লেগেছিল। শুধু তাই নয় তিনি নিজেও এ কথা জানতেন বলেই তিনি তার জীবদ্দশায় ঘটে যাওয়া ঘটনার এবং সে সম্পর্কে বলা তার উপদেশাবলি (কথার বিবরণ) নথিভূক্ত করতে নিষেধ করেছিলেন। এবং মানুষকে পরামর্শ দিয়েছিলেন কেবলমাত্র কোরআন শরীফকে অনুসরণ করতে। আপনি জানলে অবাক হয়ে যাবেন যে, এই ধরনের স্ববিরোধী কথা আপনি আপনার ধর্মগ্রন্থের মধ্যেই খুঁজে পাবেন।
সুতরাং একজন মানুষ জীবনের পরিণত পর্বে যে ভাবনা কিংবা চেতনার অধিকারী তিনি হন, তা তার পূর্বের অপূর্ণ বয়সের চিন্তা ও চেতনার মধ্যে পার্থক্য এনে দেয়। এই পার্থক্যগুলোকেই আমরা কেউ অমিল আবার কেউ 'পরস্পর বিরোধী' বলে আখ্যায়িত করে থাকি।
কিন্তু এইভাবে একজন মনীষীকে বিচার করা যায় না। বয়স ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে চিন্তা ও চেতনার এই বিবর্তনকে সামনে রেখেই একজন মনীষীর কালানুক্রমিক বক্তব্য গুলি পাঠ ও পর্যালোচনা করা দরকার হয়। তবেই বোঝা যায় যে, তিনি আসলে শেষ পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন।
কিন্তু আমরা কোন মানুষকে মূল্যায়ন করার সময় তা কি করি? করিনা। করি না বলেই আমাদের এমন মনে হয়।
স্বামী বিবেকানন্দসহ প্রত্যেক মনীষীর মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও আমাদের এই ভাবনা মাথায় রেখেই তার মূল্যায়ন করা উচিত।
সবচেয়ে বড় কথা হল, এই মূল্যায়ন করার পর তার বক্তব্যের যে অংশটুকুতে মানুষের প্রকৃত কল্যাণের জন্য, জগৎ ও জীবনের প্রকৃত সত্য উপলব্ধিতে এবং প্রকৃত শ্রেণিবৈষম্যহীন সাম্যবাদী সমাজ করে ওঠার রসদ পাব সে অংশটুকু নির্দ্বিধায় আমরা গ্রহণ করব এবং বাকিটা এড়িয়ে যাব। এটাই একজন প্রকৃত মানুষের কর্তব্য।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন