সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

সাম্যবাদীরা প্রকৃত ধর্মকে আফিম বলেননি

Bhabani Sankar Chatterjee ধর্ম মানেই আফিম এ কথা সাম্যবাদের প্রবক্তারা বলেন না। এটা একটা আরোপিত অপবাদ। আমরা যেমন মদ বললেই মাদক বুঝি, তেমন আর কি! মদ যেমন কখনও কখনও মাদক হয়ে ওঠে কিছু মানুষের ভুল ব্যাখ্যায় এবং প্রয়োগে, ঠিক তেমনি ধান্দাবাজ লোকের কব্জায় পড়ে ধর্মও কখনও কখনও আফিমের মত কাজ করে। এ বিষয়েই সতর্ক করা হয়েছে সাম্যবাদী ধ্যান ধারণায় বা দর্শনে।

সাম্যবাদের ভয়ে ধনতান্ত্রিকরা এই ব্যাখ্যায় না গিয়ে সরাসরি মদকে মাদক বলার মত করেই ধর্মকে আফিম বলে প্রচার চালায়। এটা তাদের একটা রাজনৈতিক কৌশল বা চালাকি মাত্র। আসলে, ধর্মের গুরুত্বকে মার্কসবাদ অস্বীকার করে না। অথচ প্রচার চালানো হয় এবং মার্কসবাদের বিকৃত ব্যাখ্যা করে বলা হয় যে, মার্কসবাদ ধর্মকে স্বীকার করে না, এবং আফিম বলে তাকে অপমান করে।

ধর্ম হলো মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের আধ্যাত্মিক সাধনার বা বিশ্বাসের বিষয়। যিনি বিশ্বাস করেন যে ঈশ্বর আছেন, তিনি সেই পরমাত্মার (ঈশ্বরের) সঙ্গে নিজের একাত্মতা অনুভবের জন্যই তা (ধর্ম পালন) করেন। এটা তার একান্তই ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা। এই প্রচেষ্টার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় ধ্যান-ধারণা ও কার্যকলাপের কোন সম্পর্ক নেই। 

যেমন ধরুন, আপনি যদি রাষ্ট্রের পথ-নিরাপত্তা আইন ভাঙ্গেন তাহলে আপনি যে ধর্মেই বিশ্বাস করেন না কেন আপনি তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কেন হবেন? কারণ, এই রাষ্ট্রীয় ধ্যান ধারণার (পথ নিরাপত্তা আইন) সঙ্গে আপনার সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তাই, তা মানলে লাভ, না মানলে বিপদ।

এবার আসুন, আপনি পুজো করছেন, আর একজন নামাজ পড়ছেন। তাহলে কি দাঁড়ালো? একজন আরেকজনের ধর্মীয় বিধান মানছেন না। এতে কার কী ক্ষতি হতে পারে? কারোরই কোন ক্ষতি হবে না। কারণ, নামাজ পড়া বা পূজা করার বিষয়টি ধর্মীয় বিধি-বিধান হলেও রাষ্ট্রের বা রাষ্ট্রীয় আইনের ( যেমন,পথ নিরাপত্তা আইন) মত সার্বজনীন, মৌলিক, বস্তুগত এবং কার্যকারণ সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা কোন বিষয় নয়। যদি তা হতো, তাহলে পথ-নিরাপত্তা আইন ভাঙ্গার মতই পারস্পরিক ধর্মীয় বিধি-বিধান ভাঙার কারণে পরস্পর পরস্পরের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হতো। তা কি বাস্তবে ঘটে? ঘটে না। কেন ঘটেনা? ঘটে না তার কারণ, রাষ্ট্রীয় জীবন হল সার্বজনীন যার ভিত্তি বস্তুগত আর ধর্মীয় জীবন ও তার নির্ধারিত বিধি-বিধান হল ব্যক্তিগত যার ভিত্তি হল বিশ্বাস। এ দুটোর মধ্যে কোন বস্তুগত ও কার্যকারণ সম্পর্কই নেই।

যারা রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক আছে বলে দাবি করেন, তারা আসলে মানুষের ধর্মীয় ভাবাবেককে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল এবং রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা নিজেদের গোষ্ঠী স্বার্থে ব্যবহার করার জন্যই করেন। কারণ, রাষ্ট্র ক্ষমতা যে গোষ্ঠীর হাতে থাকে, তারাই রাষ্ট্রের সমস্ত সুযোগ সুবিধা উপভোগ করার আইনি অধিকার পায়। তাই সাধারণ মানুষের ধর্মীয় ভাবাবেগকে ব্ল্যাকমেল করে ( পড়তে পারেন, সুড়সুড়ি দিয়ে) তাদের সমর্থন আদায় করে, তাদেরই শ্রমকে ফাঁকি দেয়ার জন্য তারা নানারকমের রাষ্ট্রীয় আইন-কানুন তৈরি করেন। ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ধারক ও বাহকরা যখন সাধারণ মানুষের ধর্মীয় আবেগকে সুড়সুড়ি দিয়ে এভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলে এবং তার ভোটাধিকারকে কব্জা করে নেয়, তখনই বলা হয় ধর্ম জনগনের মধ্যে আফিমের মত কাজ করছে। এ কথা বলার অর্থ মোটেই এই নয় যে, ধর্ম হল আফিম।

স্বামীজি জানতেন যে ইংরেজ সরকার যে রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক নীতিকে (ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা) ভিত্তি করে রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালনা করছে, তা সমাজে শ্রেণি বৈষম্যকে বাড়িয়ে দেবে বৈ, কমাবে না। তাই এ ধরনের রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতি কোন মোহ-ই স্বামী বিবেকানন্দের মধ্যে তৈরি হয়নি। সে কারণেই তিনি সরাসরি রাষ্ট্রনীতির সঙ্গে ধর্মনীতিকে মেলাতে চাননি এবং সচেতন ভাবেই রাজনীতিকে এড়িয়ে চলতেন। এজন্যই, তিনি তার প্রতিষ্ঠিত সংগঠনকে বা মিশনকে রাজনীতি এড়িয়ে চলারই পরামর্শ দিয়ে গেছেন। আপনি খেয়াল করলে দেখবেন, রামকৃষ্ণ মিশন কখনও কোন রাজনৈতিক এজেন্ডা গ্রহণ করে না এবং এখনও রাজনীতিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে না।

অথচ তার সমস্ত লেখা জুড়ে রয়েছে এই ধনবৈষম্য জর্জরিত সমাজব্যবস্থাকে আমুল পাল্টে দিয়ে একটি সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার ডাক। এই ডাক কে শুনতে পাননি? রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গান্ধি, সুভাষচন্দ্র বসু, চক্রবর্তী রাজা গোপাল আচারি - প্রত্যেকেই এক বাক্যের স্বীকার করেছেন তার এই ডাক শুনতে পাওয়ার কথা। সুভাষচন্দ্র বসু বলছেন, “শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দের নিকট আমি যে কত ঋণী, তাহা ভাষায় কী করিয়া প্রকাশ করিব? তাঁহাদের পুণ্য প্রভাবে আমার জীবনের প্রথম উন্মেষ। .. চরিত্র গঠনের জন্য ‘রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ সাহিত্য’ অপেক্ষা উৎকৃষ্ট সাহিত্য আমি কল্পনা করিতে পারি না।”- এ কথা শোনার পর সুভাষচন্দ্র বসু সম্পর্কে আমরা কী বলবো? তিনি বীর বিপ্লবী ছিলেন না? তিনি সমাজতান্ত্রিক ভাবনার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন না? তিনি কী শ্রেণী বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থার কথা ভাবেননি? যদি তা ভেবে থাকেন, তার সমাজ ও রাষ্ট্র দর্শনকে সমর্থন করেন, তাহলে সমাজ বিপ্লবের দিশারী স্বামী বিবেকানন্দকে ভুলে গেলেন কি করে? কেন ভুলে গেলেন? সমাজ পরিবর্তনের আজকের কান্ডারিদের এ প্রশ্নের জবাব আগামী প্রজন্মের কাছে নিশ্চয়ই দিতে হবে, যদি স্বামী বিবেকানন্দ আজকের ফ্যাসিবাদী ও পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থার হাতিয়ার হয়ে ওঠেন।

প্রসঙ্গ জানতে এখানে ক্লিক করুন

মন্তব্যসমূহ

আলী হোসেনের বহুল-পঠিত উক্তিগুলো পড়ুন

ধর্মের নামে রাজনীতিই প্রমাণ করে আমরা মধ্যযুগীয়

ধর্মের নামে রাজনীতিই প্রমাণ করে আমরা মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষে এখনও যে ধর্মের নামে রাজনীতি হয় বা হচ্ছে, তাতেই প্রমাণ হয় আমরা আধুনিক নয়, চিন্তায়-চেতনায় এখনো মধ্যযুগে বাস করি। কারণ, আধুনিক যুগের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য আছে। কোন জাতি, নিজেকে আধুনিক বলে দাবি করতে চাইলে, এই বৈশিষ্ট্যগুলো তাদের মধ্যে থাকা প্রয়োজন। এর মধ্যে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো হল ধর্ম-মুক্ত রাজনীতি। পৃথিবীর যেখানে যেখানে রাজনীতি ধর্মমুক্ত হয়েছে, সেখানে সেখানে রাজনৈতিক হিংসা হানাহানি অনেক কমে গেছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা, যা আধুনিকতার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর দিকে তাকালেই বুঝতে পারা যায় ধর্মের সঙ্গে রাজনীতি সম্পর্কিত থাকলে কি ভয়ংকর রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়। বোঝা যায়, কীভাবে নিরবিচ্ছিন্ন অস্থিরতা ও রাজনৈতিক হিংসা এবং প্রতিহিংসার দাপটে একটা জাতি শতধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। মূলত এ কারণেই, অসংখ্য ছোট ছোট, বলা ভালো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়েছে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য। ফলে সাম্রাজ্যবাদী বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর নয়া সাম্রাজ্যবাদী নাগপাশ

ধর্ম দিয়ে ধর্মান্ধতা দূর করা যায় না।

ধর্ম দিয়ে ধর্মান্ধতা দূর করা যায় না। কারণ দুটোরই ভিত্তি হচ্ছে যুক্তিবিমুখ বিশ্বাস। তাই, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা হয়তো যায়। কিন্তু ধর্ম দিয়ে ধর্মান্ধতা দূর করা কখনই যায় না। একথা ভুলতে বসেছেন যাঁরা, তাঁরা নিজেদের প্রগতিশীল দাবি করতেই পারেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এতে প্রগতিশীলতা গতিলাভ করে না বরং গতি হারায়। --------x------- Di Ansar Ali হ্যা, পরিস্থিতি অনুযায়ী সমঝোতা করতে হয়। কিন্তু মাথায় রাখতে হয়, তাতে আমার সত্যিই কোনো লাভ হচ্ছে কিনা। এবং তার অদূর ও সুদূরপ্রসারী ফলাফল প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করাটা মোটেই যুক্তিযুক্ত নয় বলেই মনে হয়। কারণ, তাতে পরের যাত্রা হয়তো ভঙ্গ হয়, কিন্তু নিজের শরীরে ভয়ঙ্কর ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়ার দখলদারি বেড়ে যেতে পারে। আমার মনে হয়, এই হিসাবটা ঠিকঠাক না করতে পারলে পরিস্থিতি অনুকূলে আসার পরিবর্তে প্রতিকূলে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। এক্ষেত্রে 'দশচক্রে ভগবান ভুত হওয়ার' বিষয়টিও মাথায় রাখার প্রয়োজন খুব বেশি বলেই আমি মনে করি। যারা প্রগতিশীল নয়, বলে এতদিন বলে আসছি তারা যদি হঠাৎ করে প্রগতিশীল হয়ে ওঠে তবে,

বিজেপি ও আরএসএস কি আলাদা?

বিজেপি ও আরএসএস-এর রসায়ন সম্পর্কে সম্যক অবহিত আছেন, এমন মানুষদের সবাই জানেন বিজেপির সঙ্গে আরএসএস-এর গভীর সম্পর্কের কথা। এবং তাঁরা এটাও জানেন যে, আরএসএস দ্বারা বিজেপি নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। তাই এই দুই সংগঠনকে আপাতদৃষ্টিতে আলাদা মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এরা আলাদা নয়। বরং এরা একে অপরের পরিপূরক। বিস্তারিত দেখুন এখানে ক্লিক করে

বিজ্ঞান শিক্ষার পরিবর্তে ধর্মশিক্ষার প্রচলন ও তার পরিণতি

দেশের বড় বড় বিজ্ঞান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেভাবে বেদ ও পুরাণসহ ধর্মশাস্ত্র পড়ানোর ধুম লেগেছে তাতে ভারতবর্ষ খুব তাড়াতাড়ি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মত অশিক্ষার কানাগলিতে ঢুকে যাবে। এভাবে চলতে থাকলে,বলা ভালো যেতে বাধ্য হবে। শিবপুর আই আই ই এস টি তে যেভাবে বেদ ও পুরাণ ভিত্তিক কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে তাতে এই আশঙ্কা প্রকট হয়ে উঠছে। সেই সঙ্গে গোলওয়ালকরের ছবি ও বই রেখে যেভাবে বিচ্ছিন্নতা ও সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন মতাদর্শকে হাইলাইট করা হচ্ছে তাতে ভারতের ভবিষ্যত দুর্দশার রূপটি স্পস্ট হয়ে উঠছে। বিস্তারিত পড়তে এখানে ক্লিক করুন ফেসবুকে দেখুন এখানে ক্লিক করে

সব মানুষই আসলে এক-একজন পাগল

মানুষ আসলে কী? সব মানুষই আসলে এক-একজন পাগল। কেউ কাজ পাগল, কেউ ফাঁকিবাজিতে পাগল। কেউ গান পাগল, তো কেউ জ্ঞান পাগল। কেউ বা আবার পান পাগল। কিছু না কিছু নিয়ে আমরা প্রত্যেকে পাগলের মত ছুটে বেড়াচ্ছি। থামবো কবে? প্রসঙ্গ জানতে এখানে ক্লিক করুন