রাজনৈতিক (মৃত্যুর) অরাজগতার কারণ
যে শিক্ষা রাজনৈতিক চেতনা আনে, সেই শিক্ষার প্রসার না ঘটলে এই রাজনৈতিক অরাজগতা কাটবে না।
শিক্ষা ও উপার্জনের অভাব - মূলত এই দুই অভাব একসঙ্গে সাধারণ মানুষকে রাজনৈতিক নেতাদের রাজনীতির বোড়ে হতে বাধ্য করে।
এই সমস্যার সমাধান করতে পারে একমাত্র রাজনৈতিক দলগুলোই। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, জনগণের রাজনৈতিক চেতনতা-বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেওয়া। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কী এবং কীভাবে তাকে প্রয়োগ করতে হবে রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য, সে সম্পর্কে অবহিত করা (রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা) রাজনৈতিক দলগুলোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে আমাদের দেশের কোন রাজনৈতিক দলই এ বিষয়ে ধ্যান দেয় না। দেবেই বা কীভাবে? রাজনীতি করতে গেলে রাজনৈতিক শিক্ষার প্রয়োজন হয়। এই শিক্ষা আসে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নামক একটি বিষয় সম্পর্কে পড়াশোনা করার মধ্য দিয়ে। এর সঙ্গে প্রয়োজন বিশ্ব-ইতিহাস ও অর্থনীতি বিষয়ে সচতনতা। অর্থাৎ কেউ রাজনৈতিক নেতা হতে চাইলে তার ন্যূনতম শিক্ষা হওয়া উচিত এই সাবজেক্টগুলোসহ গ্রাজুয়েশন পাস করা।
মনে রাখতে হবে, প্রাইভেট টিউটরের তৈরি করে দেওয়া গোটা কতক নোটস মুখস্ত করে পরীক্ষার খাতায় উগরে দিয়ে আসার মধ্য দিয়ে তা অর্জন সম্ভব নয়। আধুনিক রাষ্ট্রনীতি যা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল উপজীব্য তা অর্জন করতে গেলে এই বিষয়ের ওপর লিখিত অধ্যায়গুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়া এবং উপলব্ধি করা দরকার। দরকার তাকে প্রয়োগ করার উপযুক্ত কৌশল করায়ত্ত করা। এর মধ্য দিয়েই জন্ম নেয় একজন সৎ, পরিশীলিত ও আধুনিক রাষ্ট্রদর্শনের আলোয় আলোকিত রাজনৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন রাজনীতিক।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের হলেও সত্যি, আমাদের দেশে রাজনীতি করার যোগ্যতা অর্জিত শিক্ষা দিয়ে মাপা হয় না। মাপা হয় পেশী শক্তি দিয়ে। যে যত বড় মস্তান, সে তত বড় নেতা। অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের কর্মকর্তারা এই ভাবনাকে প্রশ্রয় দেয় শুধু নয়, এটাকে তারা কৌশলে সমর্থন করে এবং উৎসাহিত করে। ফলে আধুনিক রাজনৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন নেতার জন্ম হয় না গ্রাম বা ওয়াড পর্যায়ে। ফলে এরা হামেশাই রাজনীতির নামে গণহত্যায় মেতে ওঠে।
রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি এবং শিক্ষিত মানুষকে রাজনৈতিক নেতৃত্বে আনার চেষ্টা প্রায় কোন রাজনৈতিক দলেরই নেই। বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কিছুটা হলেও তা দেখা যেত। কিন্তু চিন্তার বিষয় হল, এদের মধ্যে এই প্রবণতা থাকলেও, যত দিন যাচ্ছে, বিষয়টি যেন তত গুরুত্ব হারাচ্ছে। একেবারে গ্রামীণ পর্যায়ে গিয়ে যদি বামপন্থী দলগুলোর নেতাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার পরিচয় সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া হয়, তাহলে দেখবেন সেখানেও নিরক্ষর কিংবা স্বল্পশিক্ষিত মানুষেরাই পার্টির মেম্বারশিপ পেয়েছেন। অথচ এলাকার উচ্চশিক্ষিত এবং রাষ্ট্রনীতি বিষয়ক শিক্ষায় শিক্ষিত সৎ যুবক বা যুবতী, যারা রাজনীতি সচেতন এবং রাজনৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন, তারা পাত্তা পাচ্ছেন না। অর্থাৎ এঁরা রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে উঠে আসার সুযোগ পাচ্ছেন না। কেননা, সেখানে রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে উঠে আসার একমাত্র শর্ত রাজনৈতিক মূল্যবোধ বা শিক্ষা না হয়ে প্রতিষ্ঠিত নেতার আনুগত্য, তেল দেওয়া এবং গোষ্টিবাজিতে নিপুণ হয়ে ওঠার কূটকৌশল প্রাধান্য পাচ্ছে। এভাবে যারা নেতৃত্বে আসছে তারা নীতি বিবর্জিত রাজনীতির কারবারি হয়ে উঠছে এবং ধনতান্ত্রিক মতাদর্শে বিশ্বাসী মানুষের মত রাজনীতিকে পেশা হিসেবে দেখতে শুরু করেছে।
দ্বিতীয় যে কারণে এই অচলাবস্থা তা হল মিটিং মিছিল করে বিপক্ষকে নিজের ক্ষমতা বা জনভিত্তি কত শক্তিশালী তা জাহির করার প্রবণতা। এক সময় এটাই ছিল একমাত্র বিকল্প। রাজনৈতিক সমর্থনের মাঠ দখলের এই প্রচেষ্টা তাই মুখোমখি সংঘাতের মধ্য ঠেলে দিত সাধারণ মানুষকে।
আজ সময় বদলেছে। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় মানুষের সমর্থন পেতে কর্পোরেট মিডিয়ার পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। এটাকে উপযুক্তভাবে প্রয়োগ করতে পারলে এবং বাড়ি বাড়ি গিয়ে সামাজিক যোগাযোগ বা সম্পর্ক বাড়াতে পারলে মানুষের সমর্থন আদায় করা যায়। এর জন্য বড় বড় মিটিং মিছিল বা জমায়েত করে ক্ষমতার দম্ভ প্রকাশ করার দরকার হয় না। এই মিটিং মিছিলগুলো গণতন্ত্রের গোপনীয়তার শর্ত লংঘন করে। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর আগ্রাসী মনোভাব বাড়তে থাকে। সংঘর্ষের জন্ম হয় এখান থেকেই।
যে রাজনৈতিক কার্যকলাপে রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ে এবং তা সাংঘর্ষিক চেহারা নেয় তাকে তো কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক বলা যায় না। আমাদের রাষ্ট্রনেতাদের এই বোধ বা শিক্ষার অভাবও রাজনৈতিক মৃত্যুর অন্যতম কারণ।
এঁরা মানুষের রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধির মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করার চেয়ে মানুষের মৃত্যুকে হাতিয়ার করতে বেশি পছন্দ করে। এটা খানিকটা মানুষের পরিশ্রম করে ভাগ্য পরিবর্তন করার চেয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টার মতই সহজ কাজ। এটা অপেক্ষাকৃত সহজ বলেই মানুষ মনে করে এবং অধিকাংশ মানুষ সেটাকেই ফলো করে। রাজনৈতিক নেতারাও পরিশ্রম করে মানুষের মন জয় করার চেয়ে রাজনৈতিক মৃত্যুকে দেখিয়ে সহজেই ক্ষমতা দখল (রাজনৈতিক ভাগ্য ফেরানো) করা যায় বলে বিশ্বাস করে এবং সেটাকে লক্ষ্য করেই রাজনীতির ঘুঁটি সাজায়। ফলে রাজনৈতিক সংঘর্ষ এবং মানুষের মৃত্যু আটকানো যায় না।
মোদ্দা কথা হল, রাজনৈতিক দলগুলো মানুষের মৃত্যুর বিনিময়ে রাজনীতি করতে চায় বলেই রাজনৈতিক মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।
আসলে গণতন্ত্র হল, একটি আধুনিক রাষ্ট্রদর্শন। অর্থাৎ রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তরের বা দখলের এটা হল আধুনিকতম হাতিয়ার। যেখানে মানুষের মৃত্যু এড়িয়ে রাজনৈতিক পালাবদল সম্ভব। এই রাষ্ট্রদর্শনকে কাজে লাগাতে হলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের এই দর্শন সম্পর্কে উপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। স্কুল-কলেজের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোকেও তার নেতাকর্মীদের এ বিষয়ে পাঠদান করতে হবে।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, আমাদের দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলগুলো আধুনিক হাতিয়ার ব্যবহার করতে চাইছে বলে দাবি করছে। বিশ্বজুড়ে প্রচার করছে আমরা বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ। আবার এরাই স্কুল কলেজের সিলেবাস থেকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র দর্শনকে বাদ দিয়ে দিচ্ছেন। যে রাষ্ট্র দর্শনকে হাতিয়ার বানাবো সেই রাষ্ট্র দর্শন যদি স্কুল-কলেজে পড়ানো না হয় তাহলে কীভাবে জনগণ তা প্রয়োগ করবেন?
আধুনিক রাষ্ট্র দর্শনের মূল বক্তব্যই হলো রাজনীতি এবং ধর্মনীতিকে আলাদা করা। এই দুটোকে আলাদা করার মধ্য দিয়েই পৃথিবীতে আধুনিক রাষ্ট্র দর্শনের জন্ম হয়েছে। আমাদের দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলগুলো, এখনো এ দুটোকে একসঙ্গে রেখে রাজনীতি করার চেষ্টা করছেন। ধর্মের সঙ্গে রাজনীতির যে নাড়ির সম্পর্ক তা প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ব্যবস্থা। এক্ষেত্রে মানুষের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। কারণ, এই ব্যবস্থায় ধর্মকে হাতিয়ার করে মানুষকে ধর্মান্ধ করে ফেলা হয় এবং এই ধর্মান্ধ মানুষের সাহায্য ও সমর্থনে শাসক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। এই ব্যবস্থায় মানুষের মৃত্যুকে অমানবিক কোন কার্য বলে বিবেচনা করাই হয় না। কারণ, এই দর্শন অনুযায়ী দেশ ও ধর্মের রক্ষায় মানুষ আত্মবলিদান করবে - এটাই স্বীকৃত। এখানে ব্যক্তি মানুষের ইচ্ছা অনিচ্ছার বা মতামতের কোন সুযোগ নেই। রাষ্ট্র ও ধর্মগুরু চাইলেই মানুষকে মৃত্যুর জন্যেও প্রস্তুত থাকতে হয়।
এই ব্যবস্থার পরিবর্তন করতেই জন্ম নিয়েছে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র দর্শন। কিন্তু
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন