প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ও মানব ধর্মের মধ্যে পার্থক্য
প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের দাপটে মানব ধর্মের মুমূর্ষ-প্রায় অবস্থা।একারণেই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের চেয়ে মানব ধর্ম শ্রেষ্ঠ। কারণ, মানব ধর্ম মানুষকে ভালবাসতে শেখায়, কোনো পরিস্থিতিতেই মানুষকে হত্যা অথবা মানুষের মধ্যে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অসাম্যকে স্বীকৃতি দেয় না।
অন্যদিকে, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের নামেই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে এবং হচ্ছে। আসলে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম হলো রাজনৈতিক সংগঠনের একটি ছদ্দবেশী রূপ। ক্ষমতা দখলের জন্য কোনো কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠী তার বা তাদের রাজনৈতিক সংগঠনের গায়ে একটি ধর্মীয় আলখাল্লা মুড়িয়ে দিয়ে তাকে অন্যরূপে দেখানোর চেষ্টা করেন। এটা মানুষকে ধোঁকা দিয়ে নিজের বা নিজ গোষ্ঠীর ক্ষমতায়নকে নিশ্চিত করার একটি কৌশলমাত্র।
প্রত্যেক প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের পৃষ্ঠপোষকরা এটা বারবার করে বোঝানোর চেষ্টা করে যে মানুষের পার্থিব জীবনের সাফল্য ও ব্যর্থতা পুরোপুরি ঈশ্বর নির্ভর। তোমার অর্থনৈতিক অবস্থা ঈশ্বরী নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি যেভাবে চেয়েছেন মানুষ সেভাবেই জীবন কাটাচ্ছেন। এর থেকে মুক্তি পাবার একমাত্র রাস্তা ধর্মীয় রীতিনীতি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা। এটা সর্বৈব মিথ্যা। মনুষ্য সমাজে শ্রেণী বৈষম্যকে জিয়ে রাখার এটা একটা অন্যতম হাতিয়ার। এখানে মানুষকে দান-খয়রাতি করার পরামর্শ দেয়া হয়। কিন্তু কখনোই শ্রেণিহীন ও শোষণহীন সমাজ গঠনের কথা বলে না।
অনেকে বলেন, ধর্ম তো মানুষকে মারতে বলে না। ঠিক কথা। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের প্রধানরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ কাজে মানুষকে উৎসাহিত করে আসছেন যুগ যুগ ধরে — এ কথা অস্বীকার করা যায় না। এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, ধর্মের নামে খুব সহজেই সাধারণ মানুষকে, যিনি আধুনিক যুক্তি বিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত হননি, বা হতে পারেননি, তাকে হিংস্র জানোয়ারে পরিণত করে ফেলা যায়? আমরা কি অস্বীকার করতে পারি, রাজনীতিকরা যুগ যুগ ধরে সাধারণ মানুষের এই অজ্ঞতা ও অজ্ঞানতাকে কাজে লাগিয়েই মানব সভ্যতাকে বারবার হুমকির মুখে ফেলেছেন? আর এই ভাবনা কোনো কষ্ট কল্পনা নয়, ইতিহাসের পাতায় যুগ যুগ ধরে এ ঘটনা ঘটে যাওয়ার উদাহরণ জ্বলজ্বল করছে। ১০৯৫ থেকে ১৫৭১ সাল পর্যন্ত ক্রুসেড, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত ধর্মীয় অনুসঙ্গ ভিন্ন কোন যুদ্ধ হয়নি। ভারতের স্বাধীনতার সংগ্রামকে কলুষিত করেছে ধর্মীয় অনুসঙ্গ। ফিলিস্তিন ও ইউক্রেন জ্বলছে এই ধর্মীয় আধিপত্য কায়েমকে কেন্দ্র করেই। মায়ানমার থেকে রহিঙ্গাদের ছিন্নমূল হওয়া, ইমেমেন সহ একাধিক আফ্রিকান দেশে ধর্মকে হাতিয়ার করে রাজনীতিকরা গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশও আজ এমন পরিস্থতির মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ মানব সভ্যতার জন্য হুমকি স্বরূপ
এ কারণেই ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ মানব সভ্যতার জন্য হুমকি হিসাবে কাজ করে চলেছে।
অন্যদিকে মানবধর্ম এমন ঘটনার বিপক্ষে কথা বলে। ধর্মীয় ও শ্রেণিগত বিভাজনকে অস্বীকার করে। যুক্তি বিজ্ঞান ও মানবতার মন্ত্রকে প্রচার ও প্রসার করার চেষ্টা করে। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকারের বিরুদ্ধে এই মতবাদ জয়লাভ করেছে। বিশ্বজুড়ে অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে এমন মতবাদের ওপর নির্ভর করে মানব সভ্যতার উন্নত সংস্করণ তৈরিতে চেষ্টা করেছেন এবং করে চলেছেন।
সম্প্রতি হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল সায়েন্টিস্ট এরিকা চেনোয়েত ১৯০০ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত অনেকগুলো রাজনৈতিক আন্দোলন পর্যালোচনা করার পর তিনি বলছেন, সামগ্রিকভাবে যেসব আন্দোলনে সহিংসতা হয়েছে তার তুলনায় দ্বিগুণের বেশি সফল হয়েছে অহিংস আন্দোলন। অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে এ পর্যন্ত ৫৩ শতাংশ রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হয়েছে। উল্টোদিকে সহিংস হয়ে ওঠা আন্দোলনের মাধ্যমে কেবল ২৬ শতাংশ পরিবর্তন এসেছে।
তিব্বতের ১৪ তম দালাই লামা - আধ্যাত্মিক নেতা এবং তিব্বতের প্রধান, ইসা আমরো – ফিলিস্তিনি কর্মী ঘাসান আন্দোনি - বীর জেইট বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক, এবং একজন ফিলিস্তিনি খ্রিস্টান নেতা যিনি ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি সংঘাতে অহিংস প্রতিরোধের পক্ষে আজীবন কাজ করে গেছেন।
কোরাজন অ্যাকুইনো - ফিলিপিন্সের রাজনীতিবিদ যিনি ১৯৮৬ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ফিলিপাইনের ১১ তম রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি ছিলেন ১৯৮৬ সালের গণশক্তি বিপ্লবের সবচেয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব, যিনি রাষ্ট্রপতি ফার্দিনান্দ মার্কোসের দুই দশকের শাসনের অবসান ঘটিয়েছিল।
অং সান সু চি - মায়ানমারের রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক, লেখক। ১৯৯১ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী যিনি ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর (প্রধানমন্ত্রীর সমতুল্য) এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
এছাড়া ভারতীয় পরিবেশবাদী এবং চিপকো আন্দোলনের নেতা
সুন্দরলাল বহুগুনা, ব্রিটিশ লেখক এবং ভোটাধিকার কর্মী
লেডি ফ্রান্সেস বেলফোর, পিটার বেনেনসন (1921-2005) - ব্রিটিশ ব্যারিস্টার এবং মানবাধিকার কর্মী এবং মানবাধিকার গ্রুপ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল (AI) এর প্রতিষ্ঠাতা, রুবিনা ফিরোজ ভাট্টি (জন্ম 1969) – পাকিস্তানি মানবাধিকার কর্মী, শান্তি কর্মী এবং নেতৃত্ব পরামর্শক
গ্রেস লি বগস (1915-2015) - দার্শনিক, নারীবাদী, ডেট্রয়েট সামারের প্রতিষ্ঠাতা, মুরিয়েল ডাকওয়ার্থ (1908-2009) - কানাডিয়ান শান্তিবাদী, নারীবাদী এবং সামাজিক ও সম্প্রদায় কর্মী
ডেভিড এবারহার্ট (জন্ম 1941) – আমেরিকান শান্তি কর্মী এবং কবি, ড্যানিয়েল এলসবার্গ (1931-2023) - হুইসেলব্লোয়ার যিনি পেন্টাগন পেপারস প্রকাশ করেছিলেন, অ্যাডলফো পেরেজ এসকুইভেল (জন্ম 1931) – আর্জেন্টাইন কর্মী, সম্প্রদায় সংগঠক, চিত্রশিল্পী, লেখক এবং ভাস্কর, রুথ ফ্রাই (1878-1962) - ব্রিটিশ কোয়েকার লেখক, শান্তিবাদী এবং শান্তি কর্মী, নিচিদাতসু ফুজি (1885-1985) - জাপানি বৌদ্ধ সন্ন্যাসী, এবং বৌদ্ধ ধর্মের নিপ্পনজান-মায়োহোজি আদেশের প্রতিষ্ঠাতা, মোহনদাস গান্ধী (1869-1948) - দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারতে কৌশলবিদ এবং সংগঠক, সামিরা গুটোক (জন্ম 1974) – ফিলিপিনার নাগরিক নেতা, সাংবাদিক, পরিবেশবাদী, নারী অধিকারের আইনজীবী এবং রাজনীতিবিদ, খান আব্দুল গফফার খান (1890-1998) - পশতুন ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী, মহাত্মা গান্ধীর সহকর্মী, খুদাই খিদমতগার ইউনিফর্মধারী অহিংস সেনাবাহিনীর নেতা, ভ্যালারি কৌর (জন্ম 1981) – আমেরিকান কর্মী, তথ্যচিত্র নির্মাতা, আইনজীবী, শিক্ষাবিদ এবং বিশ্বাসী নেতা, চ্যান খোং (জন্ম 1938) - প্রবাসী ভিয়েতনামী বৌদ্ধ ভিক্ষুনি (নান) এবং শান্তি কর্মী, বার্নার্ড লাফায়েট (জন্ম 1940) – নাগরিক অধিকার সংগঠক, কিংগিয়ান অহিংসা শিক্ষাবিদ, জেমস লসন (জন্ম 1928) - নাগরিক অধিকার সংগঠক, অহিংসার কৌশলী, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র (1929-1968) - নাগরিক অধিকার সংগঠক এবং অহিংসার কৌশলী, গোপী শঙ্কর মাদুরাই (জন্ম 1991) ভারতীয় সমান অধিকার এবং আদিবাসী অধিকার কর্মী, আজিজ আবু সারাহ (জন্ম 1980) – ফিলিস্তিনি শান্তি কর্মী, সাংবাদিক, সামাজিক উদ্যোক্তা এবং রাজনীতিবিদ, ইরম চানু শর্মিলা (জন্ম 1972) – ভারতীয় নাগরিক অধিকার কর্মী, রাজনৈতিক কর্মী এবং কবি, জিন শার্প (1928-2018) - অহিংসার নেতৃস্থানীয় পণ্ডিত, পার্সি বাইশে শেলি (1792-1822) - ব্রিটিশ লেখক যিনি প্রধান ইংরেজ রোমান্টিক কবিদের একজন হিসাবে বিবেচিত হন, অস্কার সোরিয়া (জন্ম 1974) – আর্জেন্টিনার রাজনৈতিক কর্মী, সামাজিক সাংবাদিক, এবং পরিবেশ ও মানবাধিকার প্রচারক, বর্তমানে আন্তর্জাতিক অ্যাক্টিভিস্ট গ্রুপ আওয়াজ- এর প্রচারাভিযান পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন, মালালা ইউসুফজাই (জন্ম 1997) – পাকিস্তানি নারী শিক্ষা কর্মী এবং 2014 সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী
তাই ধর্ম একান্তই ব্যাক্তিগত বিশ্বাসের জায়গায় থাকা উচিত।
লেখাটি চলছে ....
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন