সম্মান কী শুধু শিক্ষকের প্রাপ্য?
শিশুমঙ্গল (রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠান) থেকে নিজের কান দেখিয়ে ফিরছি। ওষুধ কিনতে হবে, তাই অটো থেকে নেমে গেলাম। ঢুকলাম ওষুধের দোকানে...। ওষুধও নেওয়া হল। এবার দাম মেটানোর পালা। এমন সময় করিম ভাই ঢুকলেন। সঙ্গে একজন ভদ্রলোক।
করিম ভাই আমাকে দেখেই অবাক হয়ে গেলেন। জিজ্ঞাস করলেন, আপনি এখানে? আমি বললাম, ‘হু...।’ ওষুধ নিচ্ছি— বলার সুযোগ দিলেন না। জিজ্ঞেস করলেন, অফিস জাননি?
আমি বললাম, ছুটি তো!
করিম ভাই দ্বিতীয়বার অবাক হলেন! তারপর, যেন সম্বিত ফিরে পেলেন। বললেন, ‘ওহ! আপনি তো আবার মাস্টারমশাই। মাস্টার মানেই ছুটি।’ সঙ্গে এক গাল (দাঁত বের করে) হাসি। হাসির মধ্যে যে উপহাসটা ছিল, সেটা ওনার সঙ্গে থাকা ভদ্রলোক, সম্ভবত আমার আগেই বুঝেছেন। তাই আমার প্রতিক্রিয়া দেওয়ার আগেই বললেন, এভাবে বলবেন না। শিক্ষকতা অত্যন্ত সম্মানের পেশা এবং শিক্ষক সমাজ সবচেয়ে বেশি সম্মান পাওয়ার যোগ্য একমাত্র সাম্প্রদায়। কথাগুলো বলার সাথে সাথে তিনি অভিনয় করে দেখালেন, ওনার শিক্ষকদের সঙ্গে দেখা হলে, এই বয়সেও কীভাবে তাঁদের প্রণাম করেন। ভদ্রলোকের উল্টো দিকে বসে আছেন আর একজন ভদ্রলোক (সম্ভবত, ওষুধের দোকানের মালিক)। তাঁকে উদ্দেশ্য করেই তিনি কথার শেষ অংশটা উচ্চারণ করলেন। এই ভদ্রলোকও সম্মতি সূচক মাথা নাড়লেন। সঙ্গে বললেন, ‘ওসব আমাদের সময় ছিল। এখনকার ছেলেমেয়েরা বোধায় তা করে না।’ কথাগুলো বলার সঙ্গে সঙ্গে আমার দিকে তাকালেন। এমনভাবে চাইলেন, যাতে বোঝা গেল, উনি যেটা বলেছেন, তাঁর সঙ্গে আমিও যেন একমত।
যাই হোক, করিম ভাই বোধ হয় সত্যি সত্যিই ভুলে গেছিলেন, যে আমি একজন শিক্ষক এবং স্কুলে চাকরি করি। অথবা এও হতে পারে, শিক্ষকতার পেশাকে তুচ্ছ করার মত মনোভাব তার মধ্যে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন অভিজ্ঞতা থেকে এবং সে কারণেই তিনি ভুলে যাবার ভান করে বেশ চাতুর্যের সঙ্গে তাচ্ছিল্য সূচক হাসি এবং শব্দচয়ন করেছেন। কোনটা সঠিক, তা করিম ভাই-ই বলতে পারবেন। আমি না।
এক দিক থেকে ভাবলে, ভুলে যাওয়ার কথা নয়। কারণ, অনেক দিনের পরিচয়। দেখা সাক্ষাৎ কম হলেও একেবারে হয় না তা নয়। থাকেন বাড়ির কাছেই। যাতায়াতও আমার বাড়ির সামনের পথ দিয়েই।
তবু কেন ভুলে গেলেন! যদি ভাবার চেষ্টা করি, দুটো বিষয় এখানে উঠে আসতে পারে। একটা হল, আমার বেশভূষা এবং দ্বিতীয়টা হল, মানুষের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার অভ্যাস না থাকা।
আসলে আমি যদি পরিচয় না দেই, তবে কোন মানুষের পক্ষেই বোঝা সম্ভব হয় না যে, আমি একজন লেখাপড়া জানা শিক্ষিত মানুষ কিংবা চাকরি-বাকরি করি... ইত্যাদি। এটা ওই বেশভূষায় এবং কথাবার্তায় অতি সাধারণ মানুষের ছাপ থাকা এবং মেশার কারণেই ঘটে।
নিয়মিত একজন মানুষের সঙ্গে দেখা হলে এবং গল্পগুজোব বা আড্ডায় যোগ দিলে মানুষের সঙ্গে পরিচয়টা গভীর হয়। পরস্পর কি করেন, কি নাম, কোথায় থাকেন ইত্যাদি বিষয়গুলো মনের কোনে গেঁথে যায়। ভুলে যাওয়া সম্ভাবনা থাকে না। আমার সম্পর্কে এই সম্ভাবনাটা করিম ভাইয়ের ক্ষেত্রে নেই বলে উড়িয়ে দেয়া যাবে না।
যেটাই ঘটুক, শিক্ষক সম্পর্কে দুজন মানুষের ভাবনা যে দুই মেরুতে —এটা বেশ পরিষ্কার হয়ে গেল। একজনের ভাবনায় শিক্ষক হচ্ছেন সমাজের সবচেয়ে উপরে। এবং তাঁরা সমাজের সবচেয়ে বেশি সম্মান পাওয়ার যোগ্য মানুষ। অন্যজনের ভাবনায় উল্টো। বলার সুযোগ থাকলে হয়তো বলে দিতেন— এটা একটা ফাঁকিবাজি পেশা।
কিন্তু, আসলেই কী তা-ই? আমার কাছে এই দুটো ভাবনাই ভ্রান্তিমূলক। কারণ, প্রকৃত শিক্ষা এমন এক চেতনার জন্ম দেয়, যা কোন মানুষের মধ্যে ঢুকলে, পৃথিবীর কাউকেই তিনি আর অসম্মান করতে পারেন না। কেননা, প্রকৃত শিক্ষা মানুষকে শুধু সম্মান করতেই শেখায়, অসম্মান নয়। তাই শিক্ষিত মানুষের কাছে, শুধু শিক্ষক নয়, (জাত, ধর্ম, পেশা, গায়ের রং, স্ত্রী, পুরুষ নির্বিশেষে সমাজের) সব মানুষই সমান সম্মান পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হয়। যিনি তা করেন না, বা কমবেশি ভাবেন, তিনি আর যাই হোন, শিক্ষিত নন।
আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা লেখাপড়া শিখি। কিন্তু প্রকৃত শিক্ষিত হয়ে উঠতে পারি না।
এখন প্রশ্ন হল, এ দ্বায় কার? শুধুমাত্র শিক্ষকের? উত্তর হল, হ্যাঁ। কিন্তু যেটা জানিনা, তাহল, এই শিক্ষক শুধুমাত্র স্কুলে থাকেন না। থাকেন ঘরেও। এরা হলেন বাবা মা সহ পরিবারের সঙ্গে থাকা পরিণত বয়সের মানুষজন। তাদের কাছে থেকেই ছোটরা নিজের শিক্ষাজীবন শুরু করে। এরাই একজন শিশুর কাছে প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষক বা শিক্ষিকা। এখান থেকেই তারা শেখে, কী করা উচিত, কীভাবে করা উচিত, কী না করা উচিত ইত্যাদি আরও অনেক ব্যবহারিক শিক্ষা।
এই শিক্ষকদের একটা অংশ থাকেন সমাজে। যেমন, বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসাদার, কৃষক.... ইত্যাদি। এদের দেখেও শিশুরা শেখে, অনুপ্রাণিত হয়, অনুকরণ করার চেষ্টা করে।
এই শিক্ষকদের আর একটা অংশ থাকেন রাষ্ট্রপরিচালনার বিভিন্ন পদে। যেমন, নেতা, মন্ত্রী, আমলা... ইত্যাদি। সেখান থেকেও মানুষ শেখে ন্যায়-অন্যায়, আইনি-বেআইনি ও পরিসেবা সংক্রান্ত শিক্ষা।
এখন এই জায়গাগুলো যদি শিক্ষাল্পতায় ভোগে, তবে কোথা থেকে শিখবে একজন ছাত্রছাত্রী, যে শিক্ষককে সম্মান জানাতে হয়? রিক্সাওয়ালাকে ‘এই রিক্সা’ না বলে শ্রদ্ধা সহকারে ডাকতে হয়?, জনগণের পরিষেবা দিতে বা নিতে গিয়ে ঘুষ নিতে বা দিতে নেই। ভেবে দেখুন, আপনি যদি এ শিক্ষা পেয়ে থাকেন, তবে তা প্রথমেই বাড়ি থেকেই এসেছে। তারপর কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে তার স্বপক্ষে সমর্থন পেয়েছেন।
এই যদি পরিস্থিতি হয়, কোথা থেকে জন্মাবে শিক্ষিত মানুষ। কীভাবে শিখবে একজন মানুষ, যে প্রত্যেক মানুষের উচিত প্রত্যেক মানুষকে সমান শ্রদ্ধা ও সম্মান দেখানো। ঘরে, বাইরে, চতুর্দিকে যেখানে অসাম্য আর বৈষম্যের নাচানাচি, সেখানে একজন আরেকজনকে সমান সম্মান ও শ্রদ্ধা দেখাবে কী করে? আলাদা করে সম্মান ও শ্রদ্ধার কথা তো তখনই ওঠে, যখন সমাজে অসাম্য ও বৈষম্যকে স্বীকার করে নেওয়া হয়। সবাইকে শ্রদ্ধা করতে শিখলে তো শিক্ষককে আলাদা করে শ্রদ্ধা জানানোর হয় না বলে হাহুতাশ করতে হয় না। আসলে শিক্ষককে বেশি শ্রদ্ধা জানানো, ডাক্তারকে ভগবান ভাবা... ইত্যাদি বলে দাবি করার মধ্যেই রয়েছে অসাম্য এবং বৈষম্যেকে টিকিয়ে রাখার গোপন বাসনা ।
আর এ কারণেই সমাজে ‘করিম ভাই’দের জন্ম হয়েছে। করিম ভাই একজন বাস্তব চরিত্র হলেও আমার লেখায় তিনি একজন রূপক চরিত্র। কেননা, ব্যক্তি করিম ভাইকে আমি অসম্মান করতে পারি না। কারণ, ব্যক্তি করিম ভাই এই অশিক্ষা নিয়ে জন্মাননি। কোন মানুষ, কোন অনুচিত অভ্যাস নিয়ে পৃথিবীতে আসে না। আমরা বড়রা, যারা সমাজ পরিচালনা করি, তারাই তাদের অনুচিত কাজের চর্চা করার প্রেরণা যোগাই। তাই সেও একদিন শিক্ষার নাম করে অশিক্ষার অন্ধকারে ডুবে যায়। আর এভাবেই তাঁর প্রকাশ ঘটে।
----------xx----------
--------xx-------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন