প্রিয় হয়ে ওঠার কারণ কী?
প্রিয় হওয়ার উপায় কী?
আমরা হর-হামেশাই বলে থাকি ‘সে আমার প্রিয়’ বা ‘আমি তার খুব প্রিয় মানুষ’। কিংবা বলে থাকি, ও আমার ভালবাসার মানুষ। কেউ কেউ গর্ব করে বর্ননা করেন, কারও কাছে কীভাবে তিনি একজন প্রিয় মানুষ হয়ে উঠেছেন তার দারুণ কাহিনি।
প্রশ্ন হল, একজন মানুষ কীভাবে আরেকজন মানুষের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠেন? এই প্রশ্নটার একটি যথাযথ উত্তর দীর্ঘদিন ধরে খুঁজেছি। কারণ, আমি কখনও কারও প্রিয় মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছি বলে মনে হয়নি। বলা ভালো, তেমন গুণের অধিকারী বলে কেউ আমাকে এখনও প্রত্যায়িত করেনি। কেউ করলেও তার মধ্যে যে কতটা নিঃশর্ত আন্তরিকতা রয়েছে, সে বিষয়ে আমি এখনও সংশয়াতীত হতে পারিনি। অথচ প্রিয় মানুষ বা ভালো মানুষ হয়ে ওঠার বাসনা, অন্য অনেকের মত, আমার মধ্যেও আছে। ছোটবেলা থেকেই রয়েছে। বিশেষ করে মায়ের কাছে প্রিয় সন্তান হয়ে ওঠার অদম্য বাসনা আমার এখনও পূরণ হয়নি।
ফলে সব সময় এই বিষয়টা আমার মাথায় ঘুরপাক খায়। মাঝে মাঝে অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করি। ব্যর্থতার চাপে। সঙ্গে চেষ্টা করি, প্রত্যেক মানুষের কাছে, বিশেষ করে আমার মায়ের কাছে, তার একজন প্রিয় সন্তান হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে। কিন্ত কেন জানিনা, আমার মনে হয়, আমি এ কাজে এখনও সফল হইনি।
ছোটবেলা থেকেই, অবাক বিস্ময় নিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছি, এর পিছনে অন্তর্নিহিত কারণ কী আছে! আমি দেখেছি আমার বড় বোন এবং ছোট বোন মায়ের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। মেজ বোন এবং আমি সেই জায়গায় কোনদিন পৌঁছাতে পারিনি। সেজো বোনের ক্ষেত্রে মায়ের অবস্থান, ‘কম’ বা ‘বেশি’ এধরণের শব্দ প্রায়োগ করে বোঝানোর সুযোগ নেই বলে আমার মনে হয়েছে।
তবে আমার জীবনে একজন ভালোবাসার মানুষ আছে। নাম আশিষ কর্মকার। তাঁর কথা ‘দ্বিতীয় পিতা’য় (আমার লেখা একটি ছোটগল্প) লিখেছি।
আজ বয়স, অভিজ্ঞতা আর পড়াশোনার মধ্য দিয়ে অর্জিত উপলব্ধি এই ভাবনাকে অনেকটাই পরিণত করেছে। আসলে ছোট বয়সে ছোটবেলাকে ছোট চোখ দিয়ে দেখতে গেলে এবং ছোট বিচার বুদ্ধি দিয়ে বিচার করতে গেলে সেই বিচারের মধ্যে অনেক গলদ থেকে যায়। ধরা পড়ে, যখন মানুষ বড় হয়, শিক্ষার আলোয় নিজেকে আলোকিত করতে পারে। বোঝা যায়, ছোটবেলাকে ঠিকঠাক বুঝতে গেলে বড়বেলার প্রয়োজন। এর কোন বিকল্প নেই। বড় হওয়া চোখ দিয়ে নিজের সন্তানের ছোটবেলাকে যখন দেখার সুযোগ হলো, বোঝা গেল কোন সন্তানের কাছে বাবা-মা কিংবা বাবা মার কাছে কোন সন্তানের প্রিয় হয়ে ওঠার গুঢ় রহস্য।
একজন সন্তানের প্রতি পিতা মাতার মায়া, মমতা, স্নেহ ভালবাসা —যাই বলি না কেন, তা বাই ডিফল্ট তুলনাহীন থাকে। কিন্তু প্রকৃতির নিয়মেই সন্তানের প্রতি মায়ের মমতা, পিতার সঙ্গে তুলনা করলে, মা-ই এগিয়ে থাকে। কিন্তু বাস্তব জীবনে কখনও কখনও এর ব্যতিক্রমও দেখা যায়। অর্থাৎ সন্তানের প্রতি মাকেই অনেক সময় বেশি শক্ত কিংবা রুঢ় হতে দেখা যায়। কারণ, ছোটবেলার ভুল-ত্রুটি, দুষ্টামিজাত বিড়ম্বনা - সবকিছুর সামনে মাকেই সবচেয়ে বেশি পড়তে হয়। ফলে পরিস্থিতির চাপে, ভেতরটা মমতামাখা হলেও, বাইরেরটা বেশ কর্কশ হয়ে ওঠে। এজন্য সন্তানদের শাসন করার ক্ষেত্রে মায়ের ভালো-মন্দই সন্তানের উপর বেশি প্রভাব ফেলে। এই বাস্তবতার কারণেই পিতারা সন্তানের কাছে অনেকটাই প্রিয় হয়ে ওঠেন। কারণ, সারাদিন বাইরে থাকার পর, ঘরে ফিরে সন্তানদের প্রতি পিতারা একটু বেশি স্নেহা-পরায়ণ হয়ে ওঠেন এবং সন্তানের দোষত্রুটিকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উপেক্ষা করেন। মায়ের নালিশ, বাবার কাছে গুরুত্ব হারায়। ফলে সন্তানদের বাবার প্রতি টান বাড়ে। এই টান একসময় বাবাকে প্রিয় করে তোলে।
তবে মনে রাখতে হবে, বাস্তব ক্ষেত্রে, কখনো কখনো এর উল্টো অবস্থাও লক্ষ্য করা যায়। এক্ষেত্রে মায়েরা অপত্য স্নেহের আধিক্যে সন্তানদের সমস্ত দোষ ত্রুটি আড়াল করার চেষ্টা করেন। পরিস্থিতি বেগতিক হয়ে উঠলে, বাবাকেই সন্তানের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে হয়। এর পরিণতিতেই তৈরি হয় উল্টো অবস্থা।
আসলে সন্তানের কাছে মা কিংবা বাবার প্রিয় হওয়ার পিছনে কাজ করে সন্তানের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন ও সুবিধা দেওয়ার বাস্তবতা। তবে এমন ঘটনাও আছে, কিছু কিছু সন্তান এই ধরনের সুবিধা নেয় না। পারিবারিক সুশিক্ষার প্রভাবে তারা একাজ করে। এক্ষেত্রে পিতা-মাতা উভয়েই সুশিক্ষিত হওয়ার শর্ত পূরণের বাধ্যবাধকতা থাকে।
প্রিয় হয়ে ওঠার এই রসায়নকে এভাবে সুত্রায়িতো করা যায়, কখন কেউ কারও প্রিয় হয়? যখন কেউ তাকে নিঃশর্ত সমর্থন ও সুবিধা দেয়। কিম্বা এভাবেও বলা যায় : কখন কেউ কারও প্রিয় হয়? যখন কেউ কারও কাছ থেকে নিঃশর্ত সমর্থন ও সুবিধা পায়।
ছোট থেকে এই সূত্র আত্মস্ত করে বড় হয়ে ওঠা এই সব সন্তান যখন একজন নাগরিক হিসাবে দায়িত্ব পালনে নামে তখন সে প্রিয় হওয়ার এই সূত্রকেই ধ্রব সত্য হিসেবে মানে এবং নিষ্ঠা ও গর্বের সঙ্গে ব্যবহার করে। ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, আমাদের দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ব্যবস্থা এই সূত্রেই গতিশীল রয়েছে । বর্তমান সয়ম ভয়ংকরভাবে এই সূত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হচ্ছে। ন্যায়-নীতি, যুক্তিবোধ, মানবতাবোধ, ধর্মনিরপেক্ষতা, বিজ্ঞানমনস্কতা - যেগুলো আধুনিক সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য, বলা হয় প্রধান চালিকাশক্তি, তাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েই চলছে আমাদের আধুনিক রাষ্ট্র ও সমাজ-সংসার। চলছে প্রিয় হওয়ার সূত্র অনুসরণ করেই। রাষ্ট্রনেতা দেশভক্তির নামে চাইছে জনগণের কাছে নিঃশর্ত সমর্থন ও মন্ত্রী হওয়ার সুবিধা। সেখানে দেশের জন্য জনগণ, জনগণের জন্য দেশ নয়। পিতা চাইছে সন্তানের কাছে, সন্তান চাইছে পিতার কাছে নিঃস্বার্থ সমর্থন ও সুবিধা। সরকারি কর্মচারী চাইছে জনগণের কাছে নিঃশর্তে ঘুষ খাওয়ার অধিকারের সপক্ষে সমর্থন, ডাক্তার চাইছে রোগীর কাছে শর্তহীনভাবে ফি নেওয়ার পক্ষে সমর্থন। এই দৌড়ে কে নেই? খুঁজে বের করতে, দুরবিন নয়, লাগবে মাইক্রোস্কোপ।
"When someone is someone's favorite? When someone gives him unconditional support and favor.”
“কখন কেউ কারও প্রিয় হয়? যখন কেউ কাউকে নিঃশর্ত সমর্থন ও সুবিধা দেয়।”
"When someone is someone's favorite? When someone gives unconditional support and favor to someone.”
---------
"কখন কেউ কারো প্রিয় হয়? যখন সে তাকে নিঃশর্ত সমর্থন এবং সুবিধা দেয়।"
"When someone is someone's favorite? When he gives him unconditional support and favors.”
--------
“কখন কেউ কারও প্রিয় হয়? যখন কেউ কারও কাছ থেকে নিঃশর্ত সমর্থন ও সুবিধা পায়।”
"When someone is someone's favorite? When someone gets unconditional support and favor from someone.”
লেখা চলছে...
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন