প্রকৃত ধর্ম কী এবং কেন?
যে ধর্ম ধনী ও দরিদ্রের অবস্থাকে মান্যতা দেয়, এবং দরিদ্রকে ধনীরদের দান করার পরামর্শ দেওয়ার মাধ্যমে ধন-বৈষম্যকে ন্যায্যতা দেয়, সে ধর্ম ধর্মই নয়। কারণ, প্রকৃত ধর্ম মানুষের মধ্যে ধনবৈষম্যকে মান্যতা দিতে শেখায় না।
পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব ও তার ক্রমবিবর্তনের প্রথম পর্বে মানুষ সঙ্ঘবদ্ধভাবে পশু শিকার ও খাদ্যশস্য সংগ্রহের মাধ্যমে জীবন ধারণ করত। এই জীবন ব্যবস্থা মূল বৈশিষ্ট্য হল সমবন্টনের মাধ্যমে একটি সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। মানব সভ্যতার ইতিহাসে যা ‘আদিম সাম্যবাদ’ নামে পরিচিত।
সময়ের সাথে সাথে মানব সভ্যতায় আসে নানা পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের ভিত্তিভূমি হল মানুষের চিন্তাশক্তির বিবর্তন। মানুষ তার বিবর্তিত চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে আবিষ্কার করে ফেলে কৃষিকাজ। কৃষির আবিষ্কারের পর মানুষের মধ্যে দেখা দেয় সম্পদ সঞ্চয়ের প্রবণতা। জন্ম নেয় ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা। ফলে সমবন্টন ব্যবস্থার ধারণা পাল্টে যেতে থাকে। ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাড়াতে গিয়ে শুরু হয় এক ব্যক্তির সম্পদের উপর অপর ব্যক্তির কর্তৃত্ব স্থাপনের তাগিদ।
বিবর্তিত চিন্তাশক্তির কল্যাণে, বুদ্ধি ও পেশী শক্তির জোরে কিছু মানুষ সমাজে অতিরিক্ত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সুযোগ পায়। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তৈরি হয় নতুন নতুন আইন ও নীতিমালা। এই নীতিমালাকে হাতিয়ার করেই শুরু হয় সাম্যবাদী ধ্যান-ধারণাকে ভেঙে ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণাকে ন্যায্যতা দেয়ার কার্যক্রম। মান্যতা পায় এক ব্যক্তির সম্পদের উপর অপর ব্যক্তির কর্তৃত্ব স্থাপনের তাগিদ। সমাজে বঞ্চনা ও বৈষম্যের সূচনা হয় এই পটভূমিতেই।
ব্যক্তিগত সম্পত্তি বৃদ্ধির এই প্রবণতা আইনি সুরক্ষার অধিকারী হওয়ায় সমাজে ধনবৈষম্য দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে। ফলে এক শ্রেণির মানুষ সম্পদের পাহাড় বানিয়ে ফেলে এবং তারই বিপরীত ও স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় তৈরি হতে থাকে সম্পদহীন শ্রেণি । এই সম্পদ হীন মানুষই একসময় ভূমি দাসে পরিণত হয়। গড়ে ওঠে দাস সমাজ ব্যবস্থা।
প্রাচীন পৃথিবীর ইতিহাস ঘাটলেই নজরে পড়বে এই দাস ব্যবস্থার নির্মম ও নৃশংস রূপ কতটা ভয়ংকর ছিল। প্রাচীন গ্রীস এবং রোম সহ বিখ্যাত সব সভ্যতার আর্থসামাজিক ইতিহাসের পাতায় পাতায় রয়েছে তার নির্মম লিপিচিত্র।
এই দাস ব্যবস্থার শিকার হওয়া মানুষগুলোকে মুক্তি দিয়ে শোষণ মুক্ত মানব সমাজ গড়ে তোলার তাগিদটাও ধর্মচিন্তার আবির্ভাবের অন্যতম কারণ।
ধর্মচিন্তার আবির্ভাবের প্রাথমিক কারণ হলো, ১) জগৎ ও জীবনের সীমাহীন রহস্যের কার্যকারণ সম্পর্ক উদঘাটন করা এবং ২) আর্থ সামাজিক সমস্যা ও সংকট থেকে মানুষের মুক্তির উপায় খুঁজে বের করা। দ্বিতীয় কারণটি অর্থাৎ আর্থ সামাজিক বঞ্চনা ও বৈষম্য নির্মূল করতে হলে ধন বৈষম্যকে সমূলে উৎপাটন করা প্রয়োজন। দান করার মধ্যে বৈষম্য দূর করার কোন ক্ষমতা নেই। উল্টে কিছু দান করার মধ্য দিয়ে নিজের সম্পদ বৃদ্ধির নৈতিক অধিকার ও ধর্মীয় বৈধতা এনে দেয় যা আসলে পরোক্ষভাবে ধন বৈষম্যকে মেনে নেওয়ার সামিল। আর এই বৈষম্যকে মেনে নিলে মানুষের মুক্তির কিভাবে সম্ভব?
সুতরাং আপনাকে হয় মানতে হবে, ধন বৈষম্যকে সমূলে নির্মূল করতে চায় না, অথবা মেনে নিতে হবে নির্মল করতে চায়। যদি নির্মাণ করতে চায়, তাহলে দান খয়রাত অস্বীকার করতে হবে। দান-খয়রাতের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক বঞ্চনা ও বৈষম্যকে কখনোই নির্মূল করা যায় না, কিছুটা রিলিফ দেয়া যায় মাত্র।
সুতরাং দ্বিতীয় উদ্দেশ্যকে যদি আপনি ধর্মের উদ্ভবের প্রাথমিক কারণ হিসেবে মান্যতা দেন, স্বীকার করতে হবে ধর্ম অর্থ সামাজিক বৈষম্যকে মান্যতা দেয় না। অর্থাৎ প্রকৃত ধর্ম কখনো ধনবৈষম্যকে মান্যতা দিতে পারে না।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন