মানুষের ভাবনার গতিপ্রকৃতি :
মানুষ কাকে বিশ্বাস করে?
অধিকাংশ মানুষ সেই তথ্যই বিশ্বাস করে এবং তা প্রচার করে, যা তার মধ্যে আগে থেকেই ঠিক করে রাখা ধারণার সঙ্গে মিলে যায়। কারণ, তার সচেতন কিংবা অবচেতন মনে থাকা এই ধারণা বা ভাবনার সঙ্গে যখন কোন ভাবনা মিলে যায়, তখনই সে তাকে ‘সত্য’ বলে গ্রহণ করে। প্রশ্ন হতে পারে, এই পূর্ব ধারণা সে পায় কোথা থেকে? উত্তর হল, তার চারপাশ থেকে। দুই শ্রেণির মানুষ এই ধারণা তৈরি করে দেয়। একপক্ষ হল রাজনৈতিক নেতা, এবং অন্যপক্ষ ধর্মীয় নেতা।অধিকাংশ মানুষ সেই তথ্যই বিশ্বাস করে এবং তা প্রচার করে, যা তার মধ্যে আগে থেকেই ঠিক করে রাখা ধারণার সঙ্গে মিলে যায়।
ঘটনা হল, এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যদি একজন মানুষ সত্য নির্ধারণ করে, তবে সত্যের পরিবর্তে সে এক মিথ্যার জটিল আবর্তে জড়িয়ে পড়ে। কারণ, সত্য মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাস বা ভাবনা-নির্ভর নয়। মানুষের পছন্দ-অপছন্দের উপরও তা নির্ভর করে না। সত্য পরিচালিত হয় প্রাকৃতিক ও রাষ্ট্রীয় বিধি-বিধান দ্বারা, এবং প্রমাণিত হয় তার ইতিবাচক ফলাফল প্রকাশ পাওয়ার মাধ্যমে। ইতিবাচক ফলাফল হল সেটাই, যা মানুষের কল্যাণ বয়ে আনে। যে ভাবনা মানুষের অকল্যাণ ডেকে আনে, তা মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও ভালোবাসার জায়গাকে জটিল করে তোলে এবং মানুষের জীবন গভীর সংকটের মধ্যে পড়ে যায়। তখন তা আর ইতিবাচক বলে গণ্য হয় না।
তাই একজন মানুষের প্রধান কাজ হল, নৈর্ব্যক্তিকভাবে প্রকৃত সত্য অনুসন্ধান করা। সেই সত্য, যা কেবল এবং কেবলমাত্র সব মানুষের কল্যাণ বয়ে আনে।
কিন্তু এই সত্য নির্ধারণ করার জন্য যা অত্যন্ত জরুরি, তা হল যুক্তি, বুদ্ধি ও তথ্য দিয়ে কোন কিছুকে যাচাই করার ইচ্ছা শক্তি। এই শক্তি তারাই অর্জন করতে পারে, যারা শিক্ষিত ও সচেতন মানুষ। যারা কোন কিছুকে সত্য বলে গ্রহণ করার জন্য বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া অবলম্ব করে, তারাই প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত ও সচেতন মানুষ হয়ে উঠতে পারে। আমরা অধিকাংশ মানুষ এই পদ্ধতি অবলম্বন করি না। ফলে, সত্য কখনও মিথ্যা হিসেবে আমাদের সামনে হাজির হয়, আবার কখনো মিথ্যাই সত্য হিসেবে উঠে আসে। দুর্ভাগ্যের হলেও সত্য, অবলীলায় আমরা তা গ্রহণ করি।
কোন দেশের জনসমাজ যদি এই সঠিক ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সত্য উপলব্ধির চেষ্টাকে আত্মস্থ না করে, তবে সে দেশ এগোতে পারে না। কারণ, এগোতে পারার প্রথম শর্ত হল শিক্ষিত এবং সচেতন জনসমাজ গড়ে ওঠা।
শিক্ষিত ও সচেতন জনসমাজ হল তারা, যারা কোন কিছু বিশ্বাস করার আগে, তা যুক্তি, বুদ্ধি ও তথ্য দিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করার, এবং তার সত্যাসত্য যাচাই করার ক্ষমতা রাখে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কেবল সে-ই তথ্য যাচাই করতে পারে, যার মধ্যে ১) নিখাদ মানবতাবোধ বা মানব প্রেম কাজ করে, ২) যিনি যুক্তিবাদী মানসিকতার অধিকারী হন এবং ৩) চিন্তা ও চেতনার মধ্যে যার বিজ্ঞানমনস্ক মন অ্যাক্টিভ (কার্যকরী) থাকে।
এখন প্রশ্ন হল মানবতাবাদ কী? মানবতাবাদ হল এমন একটি চিন্তাধারা যা একজন মানুষ অন্য সকল মানুষকে নিঃশর্তে ভালবাসতে শেখায়। যার মধ্যে এই উপলব্ধি থাকে যে, সকল মানুষের কল্যাণের মধ্যেই রয়েছে নিজের প্রকৃত কল্যাণ। মানুষ পরস্পর পরস্পরকে ভালবাসলে এবং পরস্পরের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেই মানুষের জীবন সত্যিকার অর্থে নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত হয়।
এখন এই উপলব্ধি, যা মানুষের মধ্যে মানবতাবোধের জন্ম দেয়, তা তখনই জন্মায়, যখন তার মধ্যে যুক্তিবাদী চিন্তা ও চেতনা সক্রিয় থাকে। যুক্তিবাদী চিন্তা-চেতনা, যা কার্যকারণ সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে, তাকে বলে দেয়, সার্বিক কল্যাণের কথা না ভেবে, কেবল নিজের সংকীর্ণ স্বার্থের কথা ভাবলেই ‘ইট মারলে পাটকেল খাওয়া’র পরিস্থিতি তৈরি হয়। অর্থাৎ প্রকৃত সত্য উপলব্ধি হয়।
ধর্ম যেদিন অসৎ ধর্মগুরুর হাত থেকে মুক্তি পাবে এবং রাজনীতি যেদিন ধান্দাবাজ রাজনীতিকদের আগল মুক্ত হবে, সেদিনই দেশে প্রকৃত শিক্ষিত ও সচেতন মানুষের উদ্ভব হবে।
ধর্ম যেদিন অসৎ ধর্মগুরুর হাত থেকে মুক্তি পাবে এবং রাজনীতি যেদিন ধান্দাবাজ রাজনীতিকদের আগল মুক্ত হবে, সেদিনই দেশে প্রকৃত শিক্ষিত ও সচেতন মানুষের উদ্ভব হবে। তাদের যুক্তি বুদ্ধি, যা নিয়ে তারা জন্মগ্রহণ করে, তা আরও ক্ষুরধার হবে, এবং অন্ধত্বের জঞ্জাল কেটে তারা মানুষের মুক্তির পথ করে দেবে।
পৃথিবীজুড়ে এই দুটো গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে মানুষের মধ্যে আধুনিক শিক্ষার প্রচার ও প্রসারকে বাধা দেয়। এবং এরাই মানুষের মধ্যে কিছু ভাবনা গেঁথে দেয়, (যা প্রথম অনুচ্ছেদে ‘পূর্ব ধারনা’ নামে অভিহিত করা হয়েছে) যার দ্বারা তারা তাদের ওপর পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে পারে। কীভাবে?
ইতিহাস বলছে, মানুষের ভালো থাকার শর্তে রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্ম হয়েছিল। কিন্তু এই ধান্দাবাজ রাজনীতিকরা, এই ভাবনাকেই উগ্র জাতীয়তাবাদের নামে উল্টে দিয়েছেন। তারা মানুষকে বোঝান, মানুষের জন্য রাষ্ট্র নয়, রাষ্ট্রের জন্য মানুষ। একই রকম ভাবে, অসৎ মানুষের শাসন ও শোষণের হাত থেকে রক্ষার জন্যই যে ধর্মের জন্ম হয়েছিল, একশ্রেণির ধর্মগুরু সেটাকেই চেপে গিয়ে, উল্টোটা বোঝান। তারা বোঝান, ধর্মকে রক্ষা করাই মানুষের প্রধান কাজ। অর্থাৎ ধর্ম তোমার জন্য কিছু করতে পারুক বা না পারুক, তোমাকে ধর্মের জন্য কিছু করতেই হবে। দরকার হলে, ধর্ম রক্ষায় জীবনও দিতে হবে।
এখন যার মধ্যে যুক্তিবাদী চিন্তা চেতনার জন্ম হয়নি, যিনি বিজ্ঞানমনস্ক মনের অধিকারী নন, তার পক্ষে এই অসত্যকে ঠেলে সত্যের উপকূলে নোঙ্গর করা কঠিন কাজ। তাঁর পক্ষে বোঝা মুশকিল, ধর্মতত্ত্বে মানবতাবোধ কতটা এবং কীভাবে আছে!
প্রায় পৃথিবীজুড়েই পরিস্থিতি এখন এমন যে, এ প্রশ্ন করা যাবে না, সাধারণ মানুষকেই যদি রাষ্ট্রকে রক্ষার দায়িত্ব নিতে হয়, তাহলে সে-রাষ্ট্র থাকার দরকার কী! করলেই প্রশ্নকর্তা রাষ্ট্রদ্রোহী হয়ে যাবে। একই রকম ভাবে, মানুষকেই যদি ধর্ম (মন্দির মসজিদ কিংবা গির্জা) রক্ষার দায়িত্ব নিতে হয়, তাহলে সে ধর্ম মানার দরকার কী! প্রশ্ন তুললে, তুমি ধর্মদ্রোহী হয়ে যাবে।
বিস্ময়ের হলেও এ কথা সত্য, মানুষ একথা শুনছেন এবং মানছেন। চেতন মন বেয়ে অবচেতন মনে এই ভাবনা স্থায়ী আসন পেতে বসেছে। ফলে ধর্মের নামে অধর্ম আর রাজনীতির নামে দুর্নীতি গেঁড়ে বসেছে।
----------xx--------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন