সরকারি স্কুল উঠে যাওয়ার কারণ
সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা নিজের সন্তানকে সরকারি স্কুলে পড়ান না কেন?
শিক্ষক মহাশয়। সরকারি স্কুলে চাকরি করেন। সম্মানজনক মাইনেও পান। গড়ে ৪০ থেকে ১ লাখ। সেই মাইনের অর্থ দিয়ে নিজের সন্তানকে বেসরকারি স্কুলে বহু অর্থ খরচ করে পড়ান। সেখানে যিনি পড়ান, তিনি মাইনে পান, সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। তাঁর এই মজুরি সম্মানজনকও নয়, পর্যাপ্তও নয়।
এত অল্প অর্থে তিনি পড়ান কেন? কারণ, সরকারি স্কুলে চাকরি করতে গেলে যে পরীক্ষা দিতে হয়, সে পরীক্ষায় তিনি উন্নীত হতে পারেননি।
সরকারি স্কুলের শিক্ষক মহাশয় মনে মনে ভাবেন, তিনি উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত। তাই তো চাকরিটা তিনি পেয়েছেন। এজন্য তিনি গর্ববোধও করেন। সঙ্গে ভাবেন, তিনি শুধু শিক্ষিত নন, বুদ্ধিমানও বটে। সেই বুদ্ধি দিয়ে বিশ্লেষণ করেই তিনি উপলব্ধি করেছেন, সরকারি স্কুলে পড়াশোনা হয় না। সুতরাং সেখানে তিনি নিজের সন্তানকে পড়াবেন কেন?
কিন্তু শিক্ষক মহাশয়ের এই বুদ্ধি এতটাই ক্ষুরধার যে, সাধারণ কোন ভাবনা সেখানে ঠাই পায় না। সেকারণেই তিনি ভেবেই পান না :
১) তিনি নিজেই যদি নিজের সন্তানকে নিজের (সরকারি) স্কুলে না পড়ান, তবে সাধারণ মানুষ তার সন্তানকে আপনার স্কুলে পড়াবেন কেন অথবা কোন ভরসায় পড়ালেন? শিক্ষক মহাশয়রা এ নিয়ে ভাবেন না। কারণ, তিনি শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান। এই সামান্য বিষয় নিয়ে ভাবাটা বেশ বোকা বোকা লাগে।
২) সরকারি স্কুলে পড়াশোনা যদি না হয়, তার মানে কী দাঁড়ায়? সাধারণ মানুষ এর মানে করেন, শিক্ষক ফাঁকিবাজ। তাই সেখানে পড়াশোনা হয় না। শিক্ষক মহাশয় তা নিয়েও ভাবেন না। কারণ, তিনি শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান। তাদেরকেই তো বলা হয় সমাজ গড়ার কারিগর। সে কি আর এমনি এমনি!
কিন্তু সাধারণ মানুষ ভাবেন। ভাবেন বলেই, হাজার কষ্টের মধ্যেও সন্তানকে বেসরকারি স্কুলে পাঠাচ্ছেন বা পাঠানোর ইচ্ছা প্রকাশ করছেন। ফলে সরকারি স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। ছাত্র-ছাত্রী না থাকলে সরকার সেই স্কুল রাখবে কেন? যৌক্তিক কারণে, ছাত্র-ছাত্রীর অভাব হলে ক'দিন পর সরকার স্কুলটাই তুলে দেবে। শিক্ষক মহাশয় এই যুক্তিটা বেশ বোঝেন। তাই সমর্থনও করেন। কেন করবেন না! তিনি যে শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান!
৩) সেখানে গজিয়ে উঠবে ঝাঁ চকচকে বেসরকারি স্কুল। শিক্ষক মহাশয় ভাবেন, উঠবেই তো। স্কুল না হলে ছেলে মেয়ে পড়াশোনা করবে কীভাবে? তাদের তো আর অশিক্ষিত করে রাখা যাবেনা।
কিন্তু এখানে তো একটা স্কুল ছিল, সেটা উঠে গেল কেন? অনেক ভাবনা চিন্তা করে এক সময় তিনি বলবেন — এই পেয়েছি। কী সেটা? পরিকাঠামো নেই। সরকারি পরিদর্শন নেই। তাই উঠে গেছে। এটা তিনি খুঁজে বের করতে পেরেছেন। কারণ, তিনি শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান।
সাধারণ মানুষ ভাবেন, শিক্ষার জন্য ঝাঁ চকচকে বাড়ি কী খুব প্রয়োজন? তাই যদি হয়, তবে রবি ঠাকুর শান্তিনিকেতনের গাছ তলায় পড়াতেন কেন? কেন ব্রিটিশ সরকারের বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা করে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলেছিলেন? সাধারণ মানুষ প্রশ্ন করে, শিক্ষকদের পেছনে যদি পাহারাদার বসাতে হবে তবে তাদের সমাজ গড়ার কারিগর বলব কেন?
শিক্ষক মহাশয় হিসেব করে বের করতে পারেন না, যে নিজের সন্তানকে একদিন এই স্কুলেই অসম্মানজনক মজুরিতে শিক্ষকতা করতে হবে। কারণ, সরকারি স্কুল তখন আর থাকবে না। এবং তাই সম্মানজনক মজুরিও শিক্ষকের সন্তান পাবে না।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন