শিক্ষিত হতে গেলে এমএ, বিএ, এমএসসি, এম কম ইত্যাদি পাস করতেই হয়, বিষয়টা মোটেই তেমন নয়। মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পাস করলেই চলে। প্রয়োজন শুধু নিরন্তর পড়াশোনা (পড়া আর শোনা) করা। চাই জগৎ ও জীবনকে জানার উদগ্র বাসনা।
‘পড়াশোনা’ শব্দটার মধ্যে দুটো জিনিস আছে। একটা পড়া, অন্যটা শোনা।
পড়া মানে নিজে নিজে পড়া। বিষয়ভিত্তিক বই, পত্রপত্রিকা, কিম্বা ম্যাগাজিন ইত্যাদি সংগ্রহ করে নিজে নিজে পড়তে থাকা। আর শোনা মানে, জানা-বোঝা মানুষের (বিভিন্ন বিষয়ে যারা বিশেষ পান্ডিত্ব অর্জন করেছেন) মতামত, বক্তব্য ইত্যাদি শোনার মাধ্যমে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে সত্য উপলব্ধি করার চেষ্টা করা।
এই দুটো পদ্ধতিতে একজন মানুষ সারা জীবন ধরে পড়াশোনা করতে পারেন। জগৎ ও জীবনের চালিকাশক্তিকে নিজস্ব যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে তার নাগাল পাওয়ার চেষ্টা করতে পারেন। আমরা সাধারণত সেটা করি না। তাই লেখাপড়া শিখেও (এম এ বিএ এমএসসি এম কম পাস করেও) শিক্ষিত হয়ে উঠতে পারি না।
আমাদের ধারণা, শিক্ষিত হতে গেলে বড় বড় ডিগ্রি অর্জন করতে হয় কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এটা একটা পদ্ধতি বটে, কিন্তু একমাত্র নয়।
শিক্ষা নিজে-নিজেই এবং নিজের চেষ্টাতেই অর্জন করতে হয়। যখন স্কুল কলেজ ছিল না, তখন কি মানুষ শিক্ষিত ছিল না। ছিল। সে শিক্ষা আসলে স্বশিক্ষা। না থাকলে সভ্যতার উৎপত্তি ও অগ্রগতি কোনটাই হত না।
স্বশিক্ষার প্রক্রিয়াকে গতিশীল করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার আয়োজন করা হয়। সে কারণেই স্কুল-কলেজের ধারণার জন্ম হয়েছে বোদ্ধা মানুষের বিবেচনার ফলশ্রুতি হিসাবে।
স্কুল কলেজে লেখাপড়ার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। বলা ভালো এর বিকল্প নেই। এগুলো আসলে শিক্ষিত হওয়ার এক বিশেষ ধরণের মাধ্যম। নদী পার হওয়ার জন্য সাঁতার যেমন একটা মাধ্যম, তেমনি নৌকা, স্টিমার, স্পিড বোর্ডও একটা মাধ্যম। এখন সাঁতার কেটে নদী পার হওয়ার চেয়ে স্পিটবোর্ড ব্যাবহার করি কেন? কারণ, এটা অধিক দ্রতগতি সম্পন্ন এবং প্রশিক্ষিত নাবিকের মাধ্যমের নির্দিষ্ট লক্ষ্যে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পৌঁছে যাওয়া অধিকতর সহজ।
ঠিক সে কারণেই আমাদের স্কুল কলেজে যাওয়া। জগত ও জীবনের রহস্য ভেদ করা এবং প্রকৃতির নিয়মকে দ্রুত জেনে নেওয়া এবং তাঁকে নিজের, দেশের ও দশের কাজে লাগানোর কৌশল আয়ত্ব করার জন্যই আমরা শিক্ষালয়কে মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করি।
এটা না করলে সারা জীবনে আমার যে নিজস্ব অর্জন হবে, তা দিয়ে আদিম মানুষের শিকারি জীবন শেষ করে পশুপালনের স্তরেও পৌঁছানোও সম্ভব হবে না। তাই শিক্ষালয়কে মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করে আমরা লক্ষ্যে পৌঁছানোর কৌশল শিখে নেই। এরপর শুরু হয় নিজে নিজে শেখার এবং শিক্ষিত হওয়ার অসীম লক্ষ্যে পৌঁছানোর আমৃত্যু প্রয়াস। একজন মানুষ নিজ চেষ্টায় সারা জীবন ধরে জগত ও জীবনের যেটুকু রহস্য ভেদ করেন বা শেখেন, তা তার পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌছোয় স্পিডবোর্ড বা রকেট গতিতে। এবং তা শিক্ষালয়কে মাধ্যম করেই। এখানেই স্কুল কলেজের গুরুত্ব।
দ্বিতীয় যে কারণে আমরা শিক্ষালয়ে যাই তা হল, একটি ডিগ্রি প্রাপ্তির প্রত্যাশা। কারণ, সেটাই দিন শেষে আমাদের রুটিরুজির নিশ্চয়তা বিধানের সহায়ক হবে বলে আমরা ভাবতে বাধ্য হই। তাই ভাবিও। যদিও এই ডিগ্রি-ডিগ্রি খেলাটা আসলে পুঁজিবাদী সমাজকে টিকিয়ে রাখার একটা কৌশলমাত্র, যা ছাঁকনির মতো কাজ করে। কারণ, পুঁজিবাদী সমাজে বৈষম্য টিকিয়ে রাখতে ডিগ্রি নামক এই ছাঁকনি তাদের পুঁজিবাদীদের কাছে প্রধান ও শক্তিশালি একটি অস্ত্র হিসাবে কাজ করে।
স্কুল-কলেজে যেটা করি, সেটা আসলে লেখাপড়া। সেখানে প্রথমে লিখতে শিখি। তারপর পড়তে শিখি। স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা লেখাপড়া শেখার কাজ শেষ করি। লেখাপড়া শেষ করে হাতে পাই ডিগ্রি। এই ডিগ্রি আসলে লেখাপড়া শেষ করার স্বীকৃতি, শিক্ষা শেষ করার নয়।
এরপর শুরু করতে হয় পড়াশোনা। প্রথমটা (লেখাপড়া) হয় স্কুল-কলেজে। আর দ্বিতীয়টা (পড়াশোনা) করতে হয় নিজে নিজে, সারা জীবন ধরে, যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে।
কিন্তু আমাদের সমস্যা হল, আমরা প্রথমটা শেষ করেই নিজের শিক্ষা সম্পূর্ন হয়েছে ধরে নিয়ে নিজেকে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষিত ভেবে বসি। তাই পরেরটাকে আর গুরুত্বই দিই না। ফলে, যা হবার তাই হয়, লেখাপড়া জানা অর্ধশিক্ষিত মানুষ হয়েই জীবন কেটে যায়। বলা ভালো কাটিয়ে ফেলি।
-------xx-------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন