হিংসা দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা কিংবা ঐক্যবদ্ধ জাতি গড়ে তোলার চেষ্টা, আসলে সাঁতার না জানা মানুষকে সমুদ্রে ফেলে দিয়ে সাঁতার শেখানোর চেষ্টার মত অবাস্তব চিন্তা।
তাছাড়া জোর করে শান্তি, ঐক্য, প্রেম বা ভালবাসা কোনটাই আসেনা। কারণ, এসব কিছুর সঙ্গে মত ও পথের সমন্বয় সাধনের অলঙ্ঘনীয় শর্ত সম্পর্কযুক্ত। এই শর্ত পূরণ না হলে ঐক্য, শান্তি, প্রেম বা ভালোবাসা কোনটাই শক্তপোক্ত ভিত পায় না।
এই সহজ সত্য যারা উপলব্ধি করতে পারে না কিংবা মানে না তাদের দিয়ে দেশের ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনা। যা হয় তা আসলে ঐক্য সংহতির ফানুস।
দেশের বর্তমান সরকার অখণ্ড ভারতের কথা ভাবছে। অথচ তা গড়ার জন্য যে নীতি ও কৌশল অবলম্বন করছে তা কখনোই সমানুপাতিক নয়। বিদ্বেষ বিচ্ছিন্নতাই বয়ে আনে, তা কখনোই ঐক্য বা সমন্বয় সাধন করতে পারেনা। অথচ এই সরকার ঐক্যের জন্য বিদ্বেষকেই, যা আসলে বিচ্ছিন্নতাকে শক্তিশালী করে বা মদত যোগায়, তাকেই আশ্রয় করছে।
আমেরিকার কিংবা রাশিয়ার সহ যে সমস্ত বৃহৎ রাষ্ট্র ব্যবস্থা পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তাদের রাষ্ট্রনীতি এখনো পর্যন্ত অদ্বিতীয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কারণ এর চেয়ে উন্নত ও সফল রাষ্ট্রনীতি পৃথিবীতে মাথা তুলে দাঁড়ায়নি। সুতরাং মানতেই হয় যে তাদের সেই রাষ্ট্রনীতির বিকল্প এখনো তৈরি হয়নি।
কী সেই রাষ্ট্রনীতি? এক কথায় তার নাম যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা। যার মেরুদন্ডই হচ্ছে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং আইন, শাসন ও বিচারবিভাগের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা ও পারস্পরিক দায়বদ্ধতা। এই দুটো জিনিস ছাড়া কখনোই বহু ভাষা জাতি ধর্ম ও বর্ণের এবং অবশ্যই সংস্কৃতির জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব নয়।
বর্তমান আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র তার যাত্রা শুরু করেছিল ১৩ টি ছোট ছোট শহরকে কেন্দ্র করে। যা আসলে ইংল্যান্ডের উপনিবেশ ছিল। সেখান থেকে তারা এখন উত্তর আমেরিকার অর্ধাংশ জুড়ে অবস্থিতির জানান দিচ্ছে। অস্বীকার করার নেই যে এই বিশাল রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলার পিছনে রয়েছে অমানবিক শাসন নির্যাতন ও শোষণের করুণ কাহিনী। একটা প্রাচীন সভ্যতাকে ধ্বংস করেই তার ভিত্তি প্রস্তর হয়েছিল। কিন্তু তারপর যে রাষ্ট্রের জন্ম হলো তা যে স্থায়িত্ব পেয়েছে এবং উত্তরোত্তর শক্তিশালী হয়েছে তার মূল চাবিকাঠি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার রাষ্ট্রনীতিকে সঠিকভাবে প্রয়োগের মাধ্যমেই। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটা অঙ্গরাজ্যের জন্য রয়েছে আলাদা পতাকা, রয়েছে আলাদা সংবিধান এবং আরো শক্তিশালী সাংবিধানিক রীতিনীতি ও আইনি সুরক্ষা যা সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রের মানুষকে নিবিড় বন্ধনে বেঁধে রেখেছে। সঙ্গে রয়েছে রাজনীতিকদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নীতি-নৈতিকতার সততা অসততা মানদণ্ডকে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলার নিঃস্বার্থ ও মানসিক শক্তি। এটা আছে বলেই সেখানে কোন রাষ্ট্রনেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেই তিনি পদত্যাগ করেন। বিচার বিভাগ কবে প্রমাণ করবে যে তিনি নির্দোষ তার অপেক্ষায় ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকেন না। স্বাধীনতা উত্তর কালে আমাদের দেশে এইরকম দৃষ্টান্ত সম্ভবত একজনই দেখিয়েছিলেন।
আমার দেশের সরকার যেভাবে এই ঐক্যবদ্ধ ভারতের স্বপ্ন দেখছেন এবং তাকে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন তা আদেও আধুনিক নয় এবং গণতান্ত্রিকও নয়। গণতান্ত্রিক ও আধুনিকতার ধারণার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে কয়েকটি অবিচ্ছেদ্য ধারণা যা যুক্তিবাদ মানবতাবাদ বিজ্ঞানমনস্কতা ব্যক্তিসাতন্ত্রবাদ ইত্যাদি নামে পরিচিত। এগুলোকে বাদ দিয়ে আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণা সোনার পাথর বাটি ছাড়া আর কিছুই নয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন