সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

“আমি ঈশ্বরের বরপুত্র” - নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদী

“আমি ঈশ্বরের বরপুত্র” - নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদী।

ইতিহাসের পাতায় কোথায় কোথায় যেন দেখেছি এমন ‘অনিন্দ্য সুন্দর বাণী’? আজ থেকে প্রায় ৩৩০০ বছর আগে মিশরের ফারাও (সম্রাট) ছিলেন চতুর্থ আমেনহোটেপ। তার আমলে মিশরে বহু দেবতায় বিশ্বাস ছিল মানুষের। এই দেবতাদের মধ্যে ‘আমেন’ ছিলেন প্রধান। মানুষের নিয়ন্ত্রণ ছিল এই বহুত্ববাদী ধর্মের ধর্মগুরুদের হাতে। তাই সম্রাটকে নির্ভর করতে হত এই ধর্মগুরুর সমর্থন পাওয়ার ওপর। অর্থাৎ জনগনের ওপর সম্রাটের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ ছিল না।

এই পরিস্থিতিতে সম্রাট আমেনহোটেপ জনগণের নিরঙ্কুশ সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে নতুন পরিকল্পনা তৈরি করেন। ঘোষণা করেন, বহুত্ববাদ সমর্থনযোগ্য নয়। কারণ, ঈশ্বর একাধিক হতে পারেন না। এই যুক্তি দেখিয়ে আমুনের পরিবর্তে একমাত্র সূর্য দেবতা আটেন-এর উপাসনার করার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং জনগণকে তার অনুসারী করে তোলার চেষ্টা করেন।

অর্থাৎ সম্রাট আমেনহোটেপ বহু-ঈশ্বরের পরিবর্তে একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠা ও এর মাধ্যমে জনগণের উপর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার জন্য এই অভিনব উদ্যোগ গ্রহণ করেন। আর এটা মাথায় রেখেই তিনি নিজের নতুন নাম গ্রহণ করেন। নাম নেন আখেনাটেন অর্থাৎ ঈশ্বর আর্টনের পুত্র। উদ্দেশ্য হল নিজেকে একাধারে প্রধান রাষ্ট্র নেতা ও ধর্মগুরু হিসেবে জনগণের সামনে তুলে ধরা এবং তাদের নিরঙ্কুশ সমর্থন আদায় করা। 

এবার আসুন চিনে। আজ থেকে ৩০০০ বছর পূর্বে চীনের সম্রাটরা নিজেদের ‘স্বর্গের সন্তান’ বলে অভিহিত করে বিপক্ষ ব্যাক্তির দেশের শাসক হওয়ার ইচ্ছাকে অবৈধ ঘোষণা করতেন। যেমন লি জিচেং , হুয়াং চাও এবং ইউয়ান শু  এভাবেই নিজেদের ‘স্বর্গের পুত্র’ বলে ঘোষণা করে অন্যদের সম্রাট পদের দাবির বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করেন এবং নিজেকে বৈধ শাসক হিসেবে ঘোষণা করেছিলে।

এবার আসেন ফ্রান্সে। অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সের বুরবোঁ রাজবংশের রাজারা তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করার জন্য নিজেদের ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলে প্রচার করতেন। তারা বলতেন রাজার আইন মানে ঈশ্বরের আইন, তাকে অমান্য করা অথবা চ্যালেঞ্জ করা মানে, স্বয়ং ঈশ্বরকে অমান্য করা। এই ক্ষমতা বলেই ফরাসি রাজা চতুর্দশ লুই বলতেন, “আমিই রাষ্ট্র” আর “আমার কথাই আইন”। কারণ, “আমি ঈশ্বর মনোনীত প্রতিনিধি”।

মনে রাখা দরকার, আধুনিক যুগের সূচনায়, দৈব রাজতন্ত্রের অবসান ঘটেছে ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। বহু জীবনের বিনিময়ে সাধারণ মানুষ অর্জন করেছিল সেই যুগান্তকারী সনদ, যা ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকার সনদ বা ‘Declaration of Rights of Man and Citizen’ — 26 August 1789 নামে পরিচিত।

কী বলা ছিল এই ঘোষণা পত্রে, যা আগে মানুষ স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারতেন না। আসুন দেখে নেওয়া যাক একঝলকে :

  1. মানুষ জন্মগতভাবে মুক্ত ও স্বাধীন; অর্থাৎ স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার।
  2. মানুষের জন্মগত অধিকারগুলো পবিত্র ও অলংঘনীয়।
  3. আইনের চোখে সব মানুষ সমান।
  4. রাষ্ট্রের প্রকৃত সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হল জনগণ।
  5. যোগ্যতা অনুসারে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পাওয়ার অধিকারী প্রত্যেকটি মানুষ।
  6. বাক স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, সম্পত্তির অধিকার প্রভৃতি হল মানুষের সর্বজনীন অধিকার।

এখন প্রশ্ন হল, আমাদের সম্মানীয় প্রধানমন্ত্রী কি নিজেকে আখেনাটেন, চিন সম্রাট হুয়াং চাও, কিম্বা অষ্টাদশ শতকের বুরবোঁ রাজবংশের রাজাদের মতো নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হতে চাইছেন? ধর্ম তথা দৈব রাজতন্ত্রের ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়ে? পার্লামেন্টে ইতিমধ্যে তিনি ‘রাজদন্ড স্থাপন’ করেছেন এবং এখন নিজেকে ‘ঈশ্বরের বরপুত্র’ বলে প্রচার করছেন। 

আমাদের প্রধানমন্ত্রী যদি এটাই চান, এবং আমরা যদি তাতেই আহ্লাদিত হই, মনে রাখতে হবে, ইতিহাস, বিশেষ করে আধুনিক ইতিহাসের সেই কারিগররা, যাঁরা জীবন মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরশাসকদের হাত থেকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা কেড়ে জনগনের হাতে অর্পণ করে গেছেন, আমাদের কখনও ক্ষমা করবেন না।

---------xx-------

মন্তব্যসমূহ

আলী হোসেনের বহুল-পঠিত উক্তিগুলো পড়ুন

ধর্মের নামে রাজনীতিই প্রমাণ করে আমরা মধ্যযুগীয়

ধর্মের নামে রাজনীতিই প্রমাণ করে আমরা মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষে এখনও যে ধর্মের নামে রাজনীতি হয় বা হচ্ছে, তাতেই প্রমাণ হয় আমরা আধুনিক নয়, চিন্তায়-চেতনায় এখনো মধ্যযুগে বাস করি। কারণ, আধুনিক যুগের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য আছে। কোন জাতি, নিজেকে আধুনিক বলে দাবি করতে চাইলে, এই বৈশিষ্ট্যগুলো তাদের মধ্যে থাকা প্রয়োজন। এর মধ্যে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো হল ধর্ম-মুক্ত রাজনীতি। পৃথিবীর যেখানে যেখানে রাজনীতি ধর্মমুক্ত হয়েছে, সেখানে সেখানে রাজনৈতিক হিংসা হানাহানি অনেক কমে গেছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা, যা আধুনিকতার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর দিকে তাকালেই বুঝতে পারা যায় ধর্মের সঙ্গে রাজনীতি সম্পর্কিত থাকলে কি ভয়ংকর রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়। বোঝা যায়, কীভাবে নিরবিচ্ছিন্ন অস্থিরতা ও রাজনৈতিক হিংসা এবং প্রতিহিংসার দাপটে একটা জাতি শতধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। মূলত এ কারণেই, অসংখ্য ছোট ছোট, বলা ভালো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়েছে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য। ফলে সাম্রাজ্যবাদী বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর নয়া সাম্রাজ্যবাদী নাগপাশ

ধর্ম দিয়ে ধর্মান্ধতা দূর করা যায় না।

ধর্ম দিয়ে ধর্মান্ধতা দূর করা যায় না। কারণ দুটোরই ভিত্তি হচ্ছে যুক্তিবিমুখ বিশ্বাস। তাই, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা হয়তো যায়। কিন্তু ধর্ম দিয়ে ধর্মান্ধতা দূর করা কখনই যায় না। একথা ভুলতে বসেছেন যাঁরা, তাঁরা নিজেদের প্রগতিশীল দাবি করতেই পারেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এতে প্রগতিশীলতা গতিলাভ করে না বরং গতি হারায়। --------x------- Di Ansar Ali হ্যা, পরিস্থিতি অনুযায়ী সমঝোতা করতে হয়। কিন্তু মাথায় রাখতে হয়, তাতে আমার সত্যিই কোনো লাভ হচ্ছে কিনা। এবং তার অদূর ও সুদূরপ্রসারী ফলাফল প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করাটা মোটেই যুক্তিযুক্ত নয় বলেই মনে হয়। কারণ, তাতে পরের যাত্রা হয়তো ভঙ্গ হয়, কিন্তু নিজের শরীরে ভয়ঙ্কর ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়ার দখলদারি বেড়ে যেতে পারে। আমার মনে হয়, এই হিসাবটা ঠিকঠাক না করতে পারলে পরিস্থিতি অনুকূলে আসার পরিবর্তে প্রতিকূলে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। এক্ষেত্রে 'দশচক্রে ভগবান ভুত হওয়ার' বিষয়টিও মাথায় রাখার প্রয়োজন খুব বেশি বলেই আমি মনে করি। যারা প্রগতিশীল নয়, বলে এতদিন বলে আসছি তারা যদি হঠাৎ করে প্রগতিশীল হয়ে ওঠে তবে,

বিজেপি ও আরএসএস কি আলাদা?

বিজেপি ও আরএসএস-এর রসায়ন সম্পর্কে সম্যক অবহিত আছেন, এমন মানুষদের সবাই জানেন বিজেপির সঙ্গে আরএসএস-এর গভীর সম্পর্কের কথা। এবং তাঁরা এটাও জানেন যে, আরএসএস দ্বারা বিজেপি নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। তাই এই দুই সংগঠনকে আপাতদৃষ্টিতে আলাদা মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এরা আলাদা নয়। বরং এরা একে অপরের পরিপূরক। বিস্তারিত দেখুন এখানে ক্লিক করে

সব মানুষই আসলে এক-একজন পাগল

মানুষ আসলে কী? সব মানুষই আসলে এক-একজন পাগল। কেউ কাজ পাগল, কেউ ফাঁকিবাজিতে পাগল। কেউ গান পাগল, তো কেউ জ্ঞান পাগল। কেউ বা আবার পান পাগল। কিছু না কিছু নিয়ে আমরা প্রত্যেকে পাগলের মত ছুটে বেড়াচ্ছি। থামবো কবে? প্রসঙ্গ জানতে এখানে ক্লিক করুন

বিজ্ঞান শিক্ষার পরিবর্তে ধর্মশিক্ষার প্রচলন ও তার পরিণতি

দেশের বড় বড় বিজ্ঞান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেভাবে বেদ ও পুরাণসহ ধর্মশাস্ত্র পড়ানোর ধুম লেগেছে তাতে ভারতবর্ষ খুব তাড়াতাড়ি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মত অশিক্ষার কানাগলিতে ঢুকে যাবে। এভাবে চলতে থাকলে,বলা ভালো যেতে বাধ্য হবে। শিবপুর আই আই ই এস টি তে যেভাবে বেদ ও পুরাণ ভিত্তিক কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে তাতে এই আশঙ্কা প্রকট হয়ে উঠছে। সেই সঙ্গে গোলওয়ালকরের ছবি ও বই রেখে যেভাবে বিচ্ছিন্নতা ও সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন মতাদর্শকে হাইলাইট করা হচ্ছে তাতে ভারতের ভবিষ্যত দুর্দশার রূপটি স্পস্ট হয়ে উঠছে। বিস্তারিত পড়তে এখানে ক্লিক করুন ফেসবুকে দেখুন এখানে ক্লিক করে