হিংসার আগুন, শুধু অন্যের নয়, নিজেকেও পোড়ায়
The fire of jealousy burns not only others, but also oneself.
দুটো কথা সমাজমাধ্যমে খুব জোরের সঙ্গেই প্রচার চলছে। একটি হল সন্ত্রাসবাদের লোকাল সাপোর্ট, এবং অন্যটি হল অধিকাংশ কাশ্মীরিই প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে সন্ত্রাসবাদের সহায়ক। এর সমর্থনে সামনে আনা হচ্ছে বহু পুরনো কিছু ভিডিও ক্লিপ, যার স্থান কালের কোন উল্লেখ নেই। এখন লোকাল সাপোর্ট ছাড়া পেহেলগাম হত্যাকাণ্ডের মত কোন কাজ যে করা যায় না —একথা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু এটা বোঝার ও বোঝানোর জন্য বহু পুরনো কোন ভিডিও ক্লিপ সামনে আনার প্রয়োজন হয় কী? হয় না। এটা এমনিতেই বোঝা যায়। তাহলে প্রশ্ন হল, এই পুরনো ক্লিপগুলো প্রচারে আনা হচ্ছে কেন?
আর গোটাকয়েক বাদে কাশ্মীরের প্রায় সবাই সন্ত্রাসবাদী, একথাও একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের নিচুতলার কর্মীদের প্রোপাগান্ডা ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ, এই অভিযোগ এখনও পর্যন্ত কোন রাজনৈতিক বিশ্লেষক, এমনকি গোয়েন্দা বিভাগও দাবি করেছে বলে আমি অন্তত শুনিনি। সরকারও সে দাবি করেনি। তাহলে আমরা এগুলো ছড়াবো কেন? ছড়ালে কার লাভ, কীভাবেই বা সেই লাভ হওয়া সম্ভব? আমি বা আপনি কি তার ভাগীদার হতে পারব?
প্রশ্ন হল, এই লোকালদের ধরবে কারা? যারা পাকিস্তান থেকে ঢুকলো, তারা এত বড় একটা হত্যাযজ্ঞ চালালো, এবং নির্বিঘ্নে পালাল। কীভাবে? তাদের চিহ্নিত করার দায়িত্ব এবং শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা দুটোই একমাত্র সরকারেরই আছে? খবরের কাগজগুলো থেকে জানা যাচ্ছে, প্রায় ৮ লাখের মতো নিরাপত্তা বাহিনী নাকি সেখানে ছিল এবং এখনও আছে। তাদের ব্যর্থতাকে বাদ দিয়ে আমরা যদি শুধু লোকালদের কথা নিয়ে মাতামাতি করি, একটি নির্দিষ্ট ধর্মের মানুষকে টার্গেট করি, তাহলে তো তা অযৌক্তিক ও হাস্যকর বলে মনে হবে। সর্বোপরি, তা জাতিকে বিপদজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করাবে। সুতরাং এসব তর্ক আমাদের (সাধারণ মানুষের) জন্য বৃথা।
ভাববার বিষয় হল, সন্ত্রাসবাদীদের কিছু লোকাল এজেন্ট তো অবশ্যই আছে। সেই সঙ্গে কিছু লোকাল মানুষকে যে তারা ভয় দেখিয়ে তাদের সহায়তা আদায় করছে না, তাও কি সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়? যদি তা করে, তবে এই ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষদের পাশে সরকার ছাড়া আর কে দাঁড়াতে পারে? সরকারের সহযোগিতা ছাড়া, বিশেষ করে তাদের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব না নিলে, কীভাবে তারা এই সমস্যার মোকাবেলা করবে? সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে একথাও সরকারকে মাথায় রাখতে হবে। কাশ্মীরের মানুষ এবারে যেভাবে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন, পথে নেমেছেন, তা তো নজিরবিহীন। বেরোনোর এই যে চেষ্টা তারা করছে, এটা যদি অস্বীকার করি, এই ঘুরে দাঁড়ানোর ঘটনার ব্যাখ্যা তাহলে কীভাবে দেওয়া সম্ভব! আর যদি সত্যিই অধিকাংশ কাশ্মীরি সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে থাকে, তাহলে কাশ্মীর নিয়ে সরকার যে দাবি করে আসছিল এতদিন, তা তো ব্যর্থ বলে প্রমাণ হয়ে যাবে! সন্ত্রাসবাদকে খতম করার জন্যই ডি মানিটাইজেশন, ৩৭০ ধারা বাতিল, জম্মু-কাশ্মীরকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করা এবং তাকে দু ভাগে বিভক্ত করা ইত্যাদি পদক্ষেপ নেওয়া তো সন্ত্রাসবাদকে নিশ্চিহ্ন করা যাবে —এই হিসাব কষেই করা হয়েছিল। সরকার দাবি করেছিল, এটাই সন্ত্রাসবাদ দমনের এক এবং অদ্বিতীয় পন্থা। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে সরকারকেই। সস্তায় বাজার গরম করা, এবং ঘৃণা ছড়িয়ে তা অর্জন করা যাবে না — জনসাধারণকেও তা বুঝতে হবে।
যদিও পরিসংখ্যান বলছে, সরকারের এই উদ্দেশ্য সফল হয়নি। বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে আসলে সন্ত্রাসবাদ কিছুটা দমন করা গেলেও, নির্মূল করা যায় না। পৃথিবীর ইতিহাসে এর কোন নজির নেই। স্থানীয় মানুষের নিরাপত্তা বিধান, তাদের চিন্তা এবং চেতনায় সন্ত্রাসবাদ বিরোধী অবস্থান গড়ে তোলা—এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাম্য, মৈত্রী, ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং সর্বোপরি সমস্ত মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জীবনধারণের জন্য নূন্যতম উপার্জন নিশ্চিত করার মাধ্যমেই কেবল তা করা সম্ভব। এই অস্ত্রেই স্থানীয় মানুষের মন জয় করা যায়। এবং এটা করা গেলেই সন্ত্রাস বন্ধ হবে বলে আশা করা যায়। কারণ, সন্ত্রাসবাদীদের প্রধান হাতিয়ার হল, জনগণের অর্থনৈতিক দুরবস্থা। এই দুরবস্থার জন্য সরকারকে দায়ী করা, এবং তা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সন্ত্রাসবাদই একমাত্র রাস্তা —এই ভুল কথাকে সঠিক পন্থা হিসেবে তুলে ধরার জন্য স্থানীয়দের মগজ ধোলাই করা হয়। তাই ভয় নয়, ভালোবাসাই পারে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে লোকাল মানুষের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করতে, এবং সরকারের সঙ্গে দূরত্ব কমাতে। মনে রাখা দরকার, এই সূত্রই আমেরিকার গৃহযুদ্ধ বন্ধ করতে এবং ঐক্যবদ্ধ আমেরিকা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল।
সন্ত্রাসবাদের জন্ম ধর্মের নামে হয়, কারণে নয়। ধর্মের নামে যারা তা করায়, তারা আসলে সংকীর্ণ রাজনীতিক, শাসকের ছদ্মবেশে শোষক। এই শাসকরূপী শোষকের চরিত্র সম্পর্কে সজাগ না করতে পারলে, মানুষকে সন্ত্রাসবাদের কবল থেকে বের করে আনা যাবে না।
আমরা বরং সরকারের কাছে দাবী করতে পারি যে, এদের ধরা হোক এবং শাস্তি দেওয়া হোক। পাকিস্তান যাতে পুনরায় এমন ঘটনা ঘটানোর সাহস না দেখায়, তার জন্য প্রয়োজনীয় তদন্ত, তাদের ইনভলমেন্টের প্রমাণ ইত্যাদি বিশ্বের দরবারে উপস্থাপন করা এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। এই কাজ তো সাধারণ জনগনের পক্ষে করা সম্ভব নয়। তাহলে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে জনগণের একাংশকে অন্য অংশের বিরুদ্ধে তাতিয়ে আমাদের (সাধারণ মানুষের) লাভ কী? মনে রাখতে হবে, সন্ত্রাসবাদের জন্ম ধর্মের নামে হয়, কারণে নয়। ধর্মের নামে যারা তা করায়, তারা আসলে সংকীর্ণ রাজনীতিক, শাসকের ছদ্মবেশে শোষক। এই শাসকরূপী শোষকের চরিত্র সম্পর্কে সজাগ না করতে পারলে, মানুষকে সন্ত্রাসবাদের কবল থেকে বের করে আনা যাবে না। এসব পুরনো ভিডিও সারাদেশে ছড়িয়ে মানুষকে আতঙ্কিত করার মাধ্যমেও তো সে কাজ হবে না! উল্টে এটা লাগাতার প্রচার করে গেলে, অচিরেই এর যে বিষময় ফল দেখা দেবে, তা একদিন আমাদেরও গিলে খাবে!
আর আমাদের মৃত্যু দেখিয়ে রাজনৈতিক নেতারা ভোটে জিতবেন। তারপর ধুমধাম করে মসনদের বসবেন। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায় — এই প্রবচন শুনে আর কতদিন আমরা আমাদের দুর্বল চেতনাকে সান্তনা দেব? ভেবে দেখা দরকার।
সুতরাং ঘৃণা ছড়ানো আমাদের কাজ না। ঘৃণা ছড়িয়ে পড়লে আমাদের কোন লাভ নেই, উল্টে ক্ষতি হবে। এটা বোঝাটা খুব জরুরী। মনে রাখা দরকার, আগুন জ্বালাতে ভালো লাগে, সেই আগুনে অন্যকে পুড়তে দেখলেও মজা লাগে। কিন্তু সেই আগুনের আঁচ যখন নিজের গায়ে লাগে, সেদিনই কেবল বোঝা যায়, আগুনটা আসলে কী! এও বোঝা যায়, সেদিন ওই আগুনটা শুধু অন্যের গায়েই লাগাইনি, অজান্তে নিজের গায়েও লাগিয়েছিলাম।
-------xx------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন