লেখাপড়া ও পড়াশোনার মধ্যে পার্থক্য :
Difference between read and study
শিক্ষা প্রধানত দুই পর্বে সম্পন্ন হয়। একটির নাম লেখাপড়া। অন্যটির নাম পড়াশোনা। অধিকাংশ মানুষ লেখাপড়া শেষ করেন কিন্তু পড়াশোনাটা আর শুরু করেন না। এর পরিণতি হল অর্ধশিক্ষিত মানুষের পরিণত হওয়া। একদিন করে যায়, অর্জিত জ্ঞান হয় ভোঁতা হয়, নয় আপডেট না হওয়ায় বাতিলের খাতায় নাম লেখানোর জন্য ছুটতে থাকে।
আপাত দৃষ্টিতে লেখাপড়া ও পড়াশোনার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কিন্তু গভীরভাবে জগৎ এবং জীবনকে উপলব্ধি করতে চাইলে এই দুটোরই প্রয়োজন গভীরভাবে অনুভূত হয়। আর তখনই এদের মধ্যের পার্থক্যটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
আসলে লেখাপড়া শব্দের মধ্যে রয়েছে লেখা এবং পড়ার গুরুত্ব। পড়ার মধ্যে দিয়ে অর্জিত উপলব্ধি কতটা সত্যকে ছুঁতে পারল, তা যাচাই করার প্রক্রিয়ার নাম লেখা। সুতরাং লেখা এবং পড়া দুটোই সমান ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। মূলত স্কুল-কলেজের অ্যাকাডেমিক পর্বকেই বলা হয় লেখাপড়া বা পড়ালেখা।
আসলে লেখাপড়ার মধ্য দিয়ে শিক্ষা নামক ইমারতের ভিত তৈরি হয়। তাই লেখাপড়াটা খুব মনোযোগ দিয়ে করা দরকার। এই ভিত দুর্বল হলে ইমারত গড়ার কাজ যথাযথভাবে সম্ভব নয়।
অন্যদিকে, শিক্ষার যে পর্বে ইবাদত গড়ার কাজ করা হয় তার নাম পড়াশোনা। এখানে পড়া এবং শোনার গুরুত্ব ঠিক ততটাই যতটা একাডেমিক পর্বে লেখাপড়ার গুরুত্ব থাকে। এই পর্বে লেখার গুরুত্বটা অপেক্ষাকৃত কম। কিন্তু পড়া ও শোনার গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি।
আমাদের ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা এবং একাডেমিক শিক্ষার পরবর্তীতে কর্মসংস্থান তৈরীর যে ব্যবস্থা, তাতে একটা বিপদজনক ফাঁক রয়েছে। লেখাপড়া শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশের পর পড়াশোনা করার কোন দায়বদ্ধতা সেখানে গুরুত্ব পায় না।
ফলে সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে একজন শিক্ষক নিজেকে আপডেট করার তাগিদ অনুভব করেন না। একজন কৃষক উন্নত প্রযুক্তি এবং তার প্রয়োগ সম্পর্কে অবহিত হওয়ার চেষ্টা করেন না। একই রকম ভাবে একজন শ্রমিক গতানুগতিক পদ্ধতিতেই তার উৎপাদন প্রক্রিয়া চালু রাখে। এবং এই রাখার মধ্যে কোন হীনমন্যতা কিংবা বাধার সম্মুখীন হয় না। কারণ, উপর মহলকে খুশি করার ক্ষমতা থাকলে, আর অন্য কিছুর প্রয়োজন হয় না। কারণ, উপর মহল খুশি হওয়ার জন্য সদা প্রস্তুত থাকেন। এই খুশি করার উপায় হিসেবে আমরা আমাদের কর্ম দক্ষতকে উন্নত কারো পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি বেছে নেই না। বেছে নেই তোষামোদ, অনৈতিক কাজে পরস্পর পরস্পরকে সহযোগিতা করা এমনকি ঘুষ দেওয়ার ক্ষেত্রেও আমরা পেছাই না। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে এই প্রবণতা প্রচন্ড উদ্বেগজনক। চাকরি হারানোর ভয় না থাকায় এই প্রবণতা খুব সহজেই বিপদজনক মাত্রা ছোঁয়।
অন্যদিকে, ভারতীয় জনগণের অধিকাংশের মনস্তত্ত্ব এমন নরম মাটি দিয়ে তৈরি যা প্রতিদিন প্রতিক্ষণ রূপ বদলাতে পারে। এই বদলের কারণে ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিত নামক কোন রং স্থায়িত্ব পায় না। এবং এটা কোন দোষের বলেও আমাদের মনস্তত্ত্ব মনে করে না।
উল্টে আমরা কোন পরিচিত জনকে ধরে বিশেষ সুবিধা নেওয়ার ঘটনাকে গর্ব করার মতো বলে মনে করি। ঘুষ দিয়ে অন্যকে পিছিয় ফেলে নিজের কাজকে আগে করে নেয়ার মাধ্যমে আমরা নিজের মধ্যে গর্ব করার মত গুণের উপস্থিতি অনুভব করি। অন্যের সঙ্গে প্রকাশ্যে তা শেয়ার গৌরব অনুভব করি। আমাদের ছাত্ররা তাই নকল করতে কিংবা অন্যের কাছ থেকে দেখে নিতে ভয় হয়তো একটু পায়, কিন্তু লজ্জা পায় না মোটেই।
এখন প্রশ্ন হল এই লেখাপড়া আমাদের কী দেয়? অথবা কেন আমরা লেখাপড়া শিখি? এই প্রশ্নের সহজ উত্তর হল শিক্ষা অর্জন করা। কিন্তু আমরা কজন জানি শিক্ষা কী? কেন আমরা শিক্ষা লাভ করি? কীভাবে তা অর্জন করা যায়? কিভাবে বুঝব আমার শিক্ষা ঠিকঠাক হলো কিনা? শিক্ষার মূল লক্ষ্য টই বা কী?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে এবং বুঝতে গেলে লেখাপড়া শেষ করেই শুরু করতে হয় পড়াশোনা। পড়াশোনা হল পড়া আর শোনার সমন্বিত প্রচেষ্টা। ‘পড়া’ মানে নতুন নতুন গবেষণালব্ধ বিষয়ে বই পড়া। আর ‘শোনা’ মানে রং না দেখে সমস্ত জ্ঞানীগুনী মানুষের আলোচনায় অংশ নেওয়া, তাঁদের বক্তব্য ও বিশ্লেষণ খোলা মনে নিরপেক্ষ মনোযোগ নিয়ে শোনা এবং যুক্তি, বুদ্ধি ও তথ্য দিয়ে তার বিচার বিশ্লেষণ করে সেখান থেকে প্রকৃত সত্য খুঁজে বের করার চেষ্টা করা। মূলত লেখাপড়া শেষ করে প্রকৃত সত্যের সন্ধান শুরু হয় এই পর্বে। আর পর্বকেই বলা হয় পড়াশোনা। মনে রাখতে হবে, এই পর্বের শুরু আছে, কিন্তু শেষ নেই। আজীবন ধারাবাহিকভাবে মানুষকে এই পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হয়। এবং একেবারে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তা জারি রাখতে হয়।
সুতরাং লেখাপড়ার মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের শিক্ষার ভিত গড়ে তুলি। আর ধারাবাহিক পড়াশোনার মধ্য দিয়ে সেই ভীতের উপর গড়ে তুলি শিক্ষার ইমারত। লেখাপড়ার সঙ্গে শিক্ষার যে সম্পর্ক তা এভাবেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
------------xx-----------
এবার আসুন বোঝার চেষ্টা করা যাক শিক্ষা কী? শিক্ষা অর্জনের মূল উদ্দেশ্যই বাকি? ক্লিক করুন এখানে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন