‘নামাজ’ আর ‘নমস্কার’এর মধ্যে সম্পর্ক
‘নামাজ’ আর ‘নমস্কার’ - একই ধাতুমূল থেকে এসেছে। আর তাহল ‘নমস্’।
ভাবুন, এটা কীভাবে সম্ভব? ধর্ম নিয়ে বিবাদ করার আগে এর ব্যাখ্যা খুঁজুন।
----------xx-----------
আসলে দুটো শব্দই এসেছে একই ভাষাগোষ্ঠী থেকে। আর তা হল, ইন্দো-ইরানিয় ভাষা গোষ্ঠী। অর্থাৎ সংস্কৃত (নমস্কার) ও ফার্সি (নামাজ) - দুটো ভাষাই এসেছে ইন্দো-ইরানিয় ভাষা গোষ্ঠী থেকে। তাই তাদের মূল ধাতু এক।
আমার ফেসবুক পোস্টের অভ্যন্তরে ছিল এই প্রশ্ন : এই বিষয় থেকে আমদের উপলব্ধি কী হওয়া উচিত? আমাদের অর্থাৎ হিন্দু মুসলমানসহ সমগ্র মানবগোষ্ঠীর মধ্যেকার সম্পর্ক কি বিরোধের, না বন্ধুত্বের কিংবা এক কথায় আত্মীয়তার?
----------xx-------
বেশ কয়েকজন ফেসবুক বন্ধু আমার বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন। বোঝাতে চেয়েছেন আমি ভুল।
আপনাদের বিনয়ের সঙ্গে জানাই, আপনাদের আলোচনায় ‘কেন আমি ভুল’ তার কোন সদুত্তর নেই। (যা আছে, তা প্রায় সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক কিছু কথা, যা আপনারা জানেন বলে দাবি করেন। তা কতটা যুক্তিযুক্ত বা তথ্যসমৃদ্ধ সে বিষয়ে আমি যাচ্ছি না। কারণ, সে বিষয়গুলো আলাদাভাবে আলোচনার দাবি রাখে। তা করাও যেতে পারে, আলাদা সময়ে।) থাকা সম্ভবও নয়। কারণ, দুটো শব্দের গর্ভগৃহ এক। তাই তারা পরস্পর পরস্পরের আত্মীয়। বিরোধ যা, তা মানুষ নিজেরা তৈরি করেছে, নিজেদের স্বার্থে। সেই স্বার্থ কখনো রাজনৈতিক ক্ষমতার দখল নেয়ার লক্ষ্যে জন্ম নিয়েছে, কখনো অর্থনৈতিক আধিপত্যের জন্য। অর্থাৎ বিভক্তির পিছনে রয়েছে মূলত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের দ্বন্দ্ব।
আবার যখন মানুষে মানুষে এই দ্বন্দ্বের অবসান ঘটাতে জন্ম নিয়েছে বিভিন্ন ধর্ম দর্শনের, এই স্বার্থান্বেষী মহল, ধর্মকেই বিকৃত করে নতুন নতুন অনুশাসন তৈরি করে, ধর্মের নামেই মানুষের ঐক্য ভেঙে দিয়েছেন। অর্থাৎ এভাবেই ধর্মের কারণেও মানব জাতি বিভক্ত হয়েছে নানা ধর্ম ও সম্প্রদায়ে। খ্রিস্টান, ইহুদি, ইসলাম সহ নানান ধর্ম সম্প্রদায়ে মানুষকে বিভক্ত করে ফেলা হয়েছে। পরবর্তীকালে এই ধর্মগুলো আবার অসংখ্য সম্প্রদায় বিভক্ত হয়েছে। শুধু তাই নয়, এক পক্ষ আরেক পক্ষের বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা শোনাচ্ছে। অসহায় সরল সহজ হতদরিদ্র মানুষ গুলো তাদের প্ররোচনায় এবং ঈশ্বরের অনুগ্রহ লাভের আশায় পরস্পরের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছে।
এভাবেই সনাতন ধর্মের এক (ব্রহ্মা) ঈশ্বর ৩৩ কোটি দেবতায় রূপান্তরিত হয়ে গেছে। আজও চলছে এই প্রক্রিয়া। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অদূর ভবিষ্যতে নতুন কোন অবতার বনে যেতে পারেন, এমন সম্ভাবনার কথাও ইতিমধ্যেই শোনা যাচ্ছে। দেখা দিয়েছে সে সম্ভাবনাও। মোট কথা, মানুষ নিজেরাই নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থেই, নিজেদের বিভক্ত করেছে। আল্লাহ বা ভগবান বা ঈশ্বর, যে নামেই তাকে ডাকেন না কেন, তিনি এই বিভক্তি করেননি। কখনো ধর্মের নামে, কখনো সংস্কৃতির নামে, কখনো বা বর্ণের নামে, আবার কখনো গোত্রের নামে এই বিভক্তি মানুষই করেছে। আবার বলছি, তার পিছনের মূল উদ্দেশ্য হল, কিছু মানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ (কুক্ষিগত) করা।
দুই ভাই আলাদা হয়ে সংসার পাতলেই যেমন রক্তের সম্পর্ক মুছে যায় না, তেমনি মতপার্থক্যের বা ব্যক্তি স্বার্থের কারণে আলাদা ধর্ম বা সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত হলেও এই রক্তের সম্পর্ক মুছে যায় না। বাইরের দিক থেকে হয়তো মুছে দেওয়া যায়, পোশাক পরিচ্ছদ বা আচার বিচারের মাধ্যমে, কিন্তু ভেতরটা সম্পূর্ণ মোছা যায় না। মোছা যায় না বলেই এই দুটো শব্দের উৎস-ভূমিও যে এক, তা এখনো মুছে ফেলা যায়নি। মোছা অসম্ভব। তাই এত মিল। একটু ভাবলেই এটা বোঝা যায়।
আচ্ছা বলুন তো, বিজ্ঞানের কথা বাদ দিন, ইসলামিক ধর্ম দর্শন অনুযায়ী পৃথিবীর প্রথম মানুষ কে? আদম তো? তার থেকেই পৃথিবীর বর্তমান জনগোষ্ঠী এসেছে বলে আপনি জানেন এবং মানেন। তাইতো? সনাতন ধর্মদর্শনেও ঠিক এমনই একজনের কথাই বলা হয়েছে, যাকে সনাতনীরা বলেন ব্রহ্মা। অন্য বৃহৎ ধর্ম গোষ্ঠীর ধর্ম গ্রন্থেও প্রায় একই রকম কথা বলা হয়েছে। সুতরাং, যে, যে নামেই ডাকুনা না কেন, এর দ্বারা কি প্রমাণ হয় না, মানবজাতির পূর্বপুরুষ এক। তাহলে মানুষ পরস্পর পরস্পরে আত্মীয় নয়?
মনে রাখতে হবে, এ কারণেই কোরআনকে শুধু মুসলমানের জন্য নয়, মানব জাতির জন্য অবতীর্ণ করা হয়েছে বলে কোরআনেই দাবি করা হয়েছে। মনে রাখতে হবে, সনাতন ধর্মদর্শনেও সমগ্র বিশ্বের মানুষকে পরস্পর পরস্পরে আত্মীয় বলে পরিচয় দেওয়া হয়েছে। মহা উপনিষদে বলা হয়েছে, বাসুধৈব কুটুম্বকম। অর্থাৎ সমগ্র বিশ্বই আসলে একটি পরিবার।
তাহলে কি দাঁড়ালো? মানবজাতির সমস্ত সদস্য পরস্পর পরস্পরের আত্মীয় নয়? ধর্মগ্রন্থাইগুলোতেই যদি একথা বলা থাকে, তাহলে ধর্ম নিয়ে এত বিরোধ কিসের? এবং কেন?
খেয়াল করে দেখেছেন, এই বিরোধের সবচেয়ে বড় বলি হয় কারা? যারা হন, তাদের সিংহভাগই হচ্ছেন গরিব, সহজ, সরল, ধর্মপ্রাণ খেটে খাওয়া মানুষ। চেয়ে দেখুন চার-পাশটা, দেশ থেকে বিশ্বময়; প্যালেস্টাইন থেকে ইউক্রেন; পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে পৃথিবীর কোন না কোন জায়গায় এই একই ঘটনা ঘটে চলেছে। আসলে ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। ভাবতে বলেছি এটাই।
ছোট্ট করে এটাই ছিল আমার বর্তমান পোষ্টের মূল বক্তব্য। বোঝাতে পারলাম? এরপরও যদি বোঝাতে না পারি, তাহলে ধরে নেব আপনাকে বোঝানোর দায়, আমার নয়। কারণ, সবার সব ক্ষমতা থাকে না। আপনাকে বোঝানোর ক্ষমতা আমার নেই।
আর মনে রাখবেন, চিন্তার এত দৈন্যতা নিয়ে বেঁচে হয়তো আপনি থাকবেন, কিন্তু মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবেন না। সারা পৃথিবীতে মুসলমানের যে দুরবস্থা, তা থেকেই এটা স্পষ্ট বোঝা যায়। দুর্ভাগ্যের হলেও সত্যিই ভারতের সংখ্যাশুরু জনগোষ্ঠীও আজ এই দৈন্যতার বড় ভাগীদার হতে চলেছে।
------------xx----------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন