প্রিয় পার্থ সারথী দাস,
চিনা পণ্য বয়কট করলে চিনের কী হবে? তারা তো বিক্রি করে মুনাফা যা করার করে নিয়েছে। পৃথিবীতে গরীব দেশের সংখ্যা কি কম পড়েছে। এখানে বিক্রি হবে না সেখানে হবে। এখান থেকে তাবু গুটিযে অন্য জায়গায় গিয়ে তাঁবু ফেলবে।
বয়কট করতে গেলে আগে নিজেকে সাবলম্বী করে তুলতে হয়। তারপর বয়কটের ডাক দিতে হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একারণেই ব্রিটিশ আমলে বয়কট আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন। তুমি নিশ্চয়ই জানো।
তাছাড়া এখন আমি পণ্য বয়কট করলে মার খাবে তো আমার দেশের ব্যবসাদার এবং কর্মচারীরা।
এটা করতে গেলে সরকারকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। এখানে ঢোকাই বন্ধ করতে হবে। আর এই ক্ষমতা তো একমাত্র সরকারেরই আছে।
যে চুক্তির কথা তুমি বলেছ, সেই চুক্তির কারণেই কোন সংঘটিত প্রতিবাদ বয়কটের ডাক দেয়া যায় না। দিলে সেটা চুক্তিভঙ্গেরই সামিল হবে। আন্তর্জাতিক স্তরে তার জন্য সরকারকেই জবাবদিহি করতে হবে। সুতরাং এই পথটা ভুল।
এক্ষেত্রে যেটা করা যেতে পারে, তা হল দেশকে আত্মনির্ভর করে তোলা। বাজারে যদি ন্যায্যমূল্যে বা সস্তায় প্রয়োজনীয় সামগ্রী দেশবাসীকে দেওয়া যায় তাহলে তারা কখনোই বিদেশী পণ্য কিনতে যাবে না। আর এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চিনা পণ্য বা বিদেশী পণ্য বয়কট হবে; তখন আন্তর্জাতিক স্তরে কোন সমস্যায় সরকারকে পড়তে হবে না। এটাই হল আসল রাস্তা।
কিন্তু ভারত সরকার সেই চেষ্টা করছে না। মুখে আত্মনির্ভরতার কথা বলছে এবং সমস্ত সরকারি সেক্টরগুলো বেসরকারি মুনাফাখোরদের হাতে তুলে দিচ্ছে। গতকালই একচল্লিশটা কয়লাখনি নিলামে তুলেছে। এর পরিণতি কি জানো। ইতিহাস নিয়ে যখন পড়ছো, পড়া টা চালিয়ে যাও। সমস্ত মতবাদের বই পড়ো। তাহলেই তুমি সব আস্তে আস্তে বুঝতে পারবে।
সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগ যদি একসঙ্গে না থাকে তাহলে স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা হয় না। সমস্ত কিছু বেসরকারি হয়ে গেলে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে সরকারের হাতে। এবং বেসরকারি হাতে চলে গেলে অর্থাৎ মুনাফাখোরদের হাতে চলে গেলে প্রকৃত শিল্পায়ন কখনোই সম্ভব নয়। বেসরকারি লক্ষ্য থাকে শুধু মুনাফা। আর এই মুনাফা করতে গিয়ে জিনিসপত্রের দাম যায় বেড়ে। কর্মীরা ন্যায্য মজুরি পান না। ফলের শিল্প সংকটের মধ্যে পড়ে, সংকটে পড়ে শিল্প শ্রমিকরা। তাদের ক্রয় ক্ষমতা কমে যায়। সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক মন্দা চলে আসে।
পৃথিবীর প্রত্যেকটা ধনতান্ত্রিক দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে তাই ভয়ংকর মন্দার মধ্যে পড়েছে। তাই আমাদের সরকার মুখে যতই আত্মনির্ভরতার কথা বলুক না কেন, এই নীতিতে আত্মনির্ভরতা সম্ভব নয়।
গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সঙ্গে চীন যে পাল্লা দিয়ে প্রতিযোগিতা করে চলেছে তার কারণটা আমাদের বুঝতে হবে। চীন আমাদের কোনদিনই বন্ধু ছিল না। হবে ও না। কিন্তু চীনের যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সেই ব্যবস্থাই তাকে আজ পৃথিবীর দ্বিতীয় শক্তিতে পরিণত করেছে। আর সেই শক্তির কারণেই সে ভারতের মতো একটা বৃহৎ জনসংখ্যার দেশকে আজ চোখ রাঙাতে সাহস পাচ্ছে। পৃথিবীর সমস্ত ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো ভারতে আসার পরিবর্তে চিনে দিয়ে কারখানা খুলেছে। তার কারণ সেখানে সম্পদের বন্টন সামাজিক মালিকানা আছে। ফলে সস্তায় শিল্প শ্রমিক পাওয়া যায়। শিল্প প্রযুক্তি সমস্ত ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ রয়েছে। কোম্পানিগুলোর ওপর রয়েছে রাষ্ট্রের কঠোর নিয়ন্ত্রণ।
আর আমাদের এখানে ঠিক তার উল্টো। কোম্পানিগুলোই সরকারের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে রেখেছে। ফলে আমাদের দেশের সরকারি-বেসরকারি মালিকানার যে ব্যবস্থা স্বাধীনতার পর শুরু হয়েছিল, তা ক্রমশ বন্ধ হতে হতে আজকের এই সরকার পুরোটাই তুলে দিতে চাইছে। সমস্ত কিছু পুঁজিবাদীদের হাতে চলে গেলে, দেশের অর্থনীতি সুস্থ প্রতিযোগিতার অভাবে, অর্থাৎ শিল্পপতিদের একাধিপত্যের কারণে ভেঙে পড়ে। আমাদের দেশের এখন ঠিক সেই অবস্থা।
এভাবে কখনো আত্ম নির্ভরতা সম্ভব নয়। আমেরিকার মতো গণতান্ত্রিক দেশ যে জনকল্যাণ মূলক নীতি গ্রহণ করে, আমাদের এখানে সেটুকু এখানে নেওয়া হয় না। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ নামাতে নামাতে কোথায় গেছে খোঁজ নিয়ে দেখেছো? কুসংস্কার অন্ধ বিশ্বাস যেভাবে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বাড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে, মানুষের চিন্তা চেতনাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে দেয়া হচ্ছে, তাতে দেশের সত্তিকারের উন্নয়ন কোনভাবেই সম্ভব নয়।
আমরা চীনকে কোনভাবেই সমর্থন করিনা। আমাদের বর্তমান সরকার চীনের ওপর কতটা পরিমাণ নির্ভরশীল সেটা আজকের এই সময় পত্রিকাটা পড়লে জানতে পারবে।
এই অবস্থায় চিনা পণ্য বয়কটের ডাক দেয়া আর আত্মহত্যা করা প্রায় সমান। তুমি চাইলেও ভারত সরকার তা করতে পারবে না। জনগণের আবেগকে কাজে লাগানোর জন্য মাঝেমাঝে বিবৃতি দেবে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রাখবে। কারণ না রেখে উপায় নেই।
আমাদের দেশের যে জনসংখ্যা, এবং তাদের যে চাহিদা তা মেটানোর ক্ষমতা আমাদের সরকারের নেই। অন্য দেশ থেকে আমদানি করতে গেলে তার যা বাজার মূল্য দাঁড়াবে তাতে আমাদের দেশের 85% মানুষ সেই পণ্য কিনে ব্যবহার করতে পারবে না তার দুর্মূল্যের কারণে। কারণ, আমরা এখনো ভয়ংকরভাবে দারিদ্রতার মধ্যে রয়েছি। এই অবস্থায় চীনের সস্তা পণ্য আমাদের দেশের মানুষকে অনেকটাই স্বাচ্ছন্দ এনে দিয়েছে। তুমি না জানলেও, বর্তমান ভারত সরকার কিন্তু জানে। রাজনীতির কারণে/খাতিরে তারা এটা প্রকাশ করে না। জনগণকে বোকা বানিয়ে ভোট নেয়ার জন্য মুখে এক কথা বলে, তলায় তলায় আরেক কাজ করে। অর্থাৎ জনগণকে বোকা বানায়। এভাবে একটা দেশের উন্নয়ন হয় না। দেশের দারিদ্রতা কাটে না।
আমরা চীনা পণ্যের বয়কটের ডাক দিচ্ছি। খানিকটা বোকার মত। বোকার মতো বলছি কেন জানো? একটা হিসাব দেখে নাও
এই বছরের হিসাব অনুযায়ী চীন থেকে আমাদের দেশে কি পরিমাণ পণ্য আমদানি করতে হয়, না হলে আমাদের দেশ চলে না দেখো :
১) ওষুধ তৈরির উপকরণ 67 %
২) ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ 67%
৩) সিন্থেটিক সুতো 46%
৪) সিনথেটিক কাপড় 36 কোটি ডলার
৫) জামার বোতাম সহ অন্যান্য সামগ্রী 14 কোটি ডলার
৬) চামড়ার পণ্য 38%
৭) স্মার্ট টিভি 45%
৮) এসি ফ্রিজ টেলিভিশন 45%
এবার চীনা বিনিয়োগ টা দেখো:
১) 2014 - 5.1%
২) 2015 - 95 দশমিক 9 শতাংশ
৩) 2016 - 31.5 শতাংশ
৪) 2017 - 166 দশমিক 9 শতাংশ
৯) 2018 - 134 শতাংশ
১০) 2019 - 123 শতাংশ
১১) 2020 - 26.3 ( বর্তমান সময়ের এই ডামাডোলের মধ্যে)
এবার ভেবে বল আমরা কি ন্যাকামো করছি না। ভারতবর্ষের প্রতিটি মানুষ জানে পাকিস্তানের চেয়ে বড় শত্রু হচ্ছে চীন। তার সঙ্গে লড়াই করতে হবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। সীমানায় এবং অভ্যন্তরে বাজার নিয়ে। আর তার জন্য দরকার বাস্তব বুদ্ধি। উপযুক্ত রণকৌশল। এবং অবশ্যই অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার মুক্ত একটা আত্মবিশ্বাসী এবং শিক্ষিত জনসমাজ।
আমরা কি সেটা করতে পারছি। আমাদের সরকার কী সেদিকে নজর দিচ্ছে। এ সরকারও দিচ্ছে না, আগের সরকারগুলোও দেয়নি। এটাই হল চরম সত্য। আমাদের দু'বছর পর চিন স্বাধীনতা লাভ করেছে। সে আমেরিকার উপরে চোখ রাঙানোর সাহস দেখাচ্ছে। ভারতের ভূ অভ্যন্তরীরে ঢুকে পড়ছে। এত শক্তি সে পেল কোথায়? আবেগে না ভেসে তার বিচার বিশ্লেষণ করো।
ভালো থেকো, ভালোবাসা নিও। মুক্তমনে পড়াশুনা করো। কোন রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে ইতিহাস জানতে চেওনা বা যেওনা। তাহলে বিভ্রান্ত হওয়া ছাড়া আর কিছুই পাবে না।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন