হিন্দু মুসলমান কখনও বন্ধু হতে পারে?
Can Hindus and Muslims ever be friends?
বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য। ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি এবং স্কুল কলেজে পড়েও এসেছি এই কথাগুলো। ফলে ভারতের সর্বত্র ছেলে মেয়েদের মধ্যে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে এক ধরনের ঐক্যবোধ পরস্পরের প্রতি আত্মীয়তাবোধ হয়ে উপস্থিত হতো। স্কুল কলেজে জাতীয় সংহতির কথা বোঝানো হতো। কেন সেই সংহতি প্রয়োজন, এই সংহতির অভাব হলে ভারতের প্রত্যেকটা মানুষের জীবনে কীভাবে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং সেটা জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষের উপরেই তার পড়বে, তারই পাঠ চলত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি রাজনৈতিক সভা সমিতি ও সামাজিক অনুষ্ঠান — সর্বক্ষেত্রেই।
ছাত্র-ছাত্রীদের প্রবন্ধ রচনার ক্ষেত্রে এটা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ফলে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান ইত্যাদি শব্দগুলো কখনোই কোনো বৈরিতার অর্থ বয়ে আমাদের সামনে আসেনি।
কিন্তু আজ সোস্যাল মিডিয়া ও কিছু টেলি মিডিয়া জুড়ে বিদ্বেষ আর বিচ্ছিন্নতার বীজ ঘুরে বেড়াচ্ছে লাগামহীন প্রশ্রয়ে। পরিবারের মধ্যে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠছে হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টান ধর্মের মানুষরা পরস্পরের কতটা শত্রু এবং কীভাবে।
আমার পড়াশোনা এবং পড়াশোনা করানোর বিষয় —দুটোই হচ্ছে ইতিহাস। ইতিহাস পড়তে গিয়েই বুঝেছি আগের ভাবনাটা কতটা সঠিক, আর এখন রাজনীতির নাম করে যা শেখানো হচ্ছে তা কতটা ভয়ানক। বিচ্ছিন্নতার বিষাক্ত বীজ জাতি ধর্ম বর্ন নির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষকে কতটা কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে তাও স্বচ্ছ আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখার মতোই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। ফলে আমার স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের পঠন-পাঠনের প্রক্রিয়ার মধ্যেও উঠে আসে বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে এবং ঐক্যের সমর্থনে নানান কথা।
এই কথাগুলো ছেলেমেয়েরা শোনে। অবাক বিস্ময়ে। চেয়ে থাকে এক অসহায় দৃষ্টি নিয়ে। কিন্তু প্রশ্ন করতে পারেনা। আমি কি বলছি, কেন বলছি। কিন্তু প্রশ্ন যে আছে, তাদের সেই অসহায় দৃষ্টি আমাকে স্পষ্ট করেই বুঝিয়ে দেয়। তাই প্রায় প্রতিদিনই উৎসাহিত করি প্রশ্ন করতে।
বছর তিনচার আগের কথা। একটি ছেলে, আমার উৎসাহিত করার সাহসে ভর করে, শেষমেষ প্রশ্ন করে বসে। তবে ক্লাসের শেষে, বাইরে এসে।
‘স্যার আপনাকে একটা কথা বলব?’
আমি বললাম, নিশ্চয়ই।
ও বলল, রাগ করবেন না তো স্যার?
আমি বললাম, নিশ্চয়ই নয়। নিশ্চিন্তে বল। প্রশ্ন করা তো তোদের অধিকার। আর, জবাব দেওয়া আমাদের দায়িত্ব।
ও সাহস নিয়ে বলল, আপনার কথাগুলো শুনলে, আমার সব কেমন যেন গুলিয়ে যায়। বুঝতে পারিনা, আপনি কি বলছেন? কোনটা ঠিক। জানেন স্যার, পড়াশোনা করতে তাই একদম ইচ্ছা করে না।
আমি বললাম, তা তুই পড়াশোনাটা করলি কবে?
ও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। থামিয়ে দিয়ে বললাম, তুই জিজ্ঞাসা করিস না কেন ক্লাসে? যখন পড়া বোঝাই?
ও আমাকে অবাক করে দিয়ে, ইতস্তত করে জানায়, স্যার, পড়ার বিষয় নয় তো। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে আপনি যে কথাগুলো বলেন না, বোঝানোর জন্য, সেগুলোই মেলাতে পারিনা, যখন বাড়িতে যাই।
জিজ্ঞাসা করলাম, যেমন?
এর জবাবে সে যা বলে, তা মনে হলে, ক্ষণিকের জন্য হলেও, আজও আতঙ্কিত বোধ করি।
সে বলে, হিন্দু মুসলমান কখনও বন্ধু হতে পারে! স্যার?
আমি প্রথমে বুঝে উঠতে পারিনি ওর প্রশ্নের গুঢ় অর্থ। তাই হাসতে হাসতেই বললাম, নিশ্চয়ই পারে। বন্ধু হতে তো দুটো মানুষ লাগে, জাত ধর্ম তো লাগে না!
কিন্তু আমাদের পাড়ার লোকেরা যে বলাবলি করে, হয় না। এক মুসলিম সহপাঠির নাম করে বলে, ও আমার বন্ধু, খুব ভালো বন্ধু। ও আমাদের বাড়িতে যায়। আমিও ওদের বাড়িতে যাই। খাওয়া দাওয়াও করি, মাঝে মাঝে। কিন্তু ও মুসলমান — একথা জানাজানি হওয়ার পর পাড়ার ওই লোকগুলোই মাকে বুঝিয়েছে, সময়কাল ভালো না। তাই মুসলমনদের সঙ্গে এত মাখামাখি ভালো না। যখন তখন ওদের বাড়িতে আসতে দিও না।
মা বলেছে, ওরা দুজন স্কুলের বন্ধু। তখন ওরা মাকে বুঝিয়েছে, মুসলমান কখনো হিন্দুর বন্ধু হতে পারেনা। আরো কি সব বুঝিয়েছে। শুনে মা বলছে আমাকে আর এই স্কুলে রাখবে না। ছাড়িয়ে অন্য স্কুলে দেবে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, আমাদের স্কুলের প্রায় ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ ছেলে মেয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। বাকি যারা, তাদের কমবেশি ৯৯ শতাংশই এসসি এসটি সম্প্রদায়ভুক্ত।
আমি প্রথমে কথাটা বিশ্বাস করিনি। ভেবেছিলাম, কোনদিন পড়া না করার বাহানা হিসাবে সে এই গল্প ফেঁদেছে। এরপর থেকে সে স্কুলে অনিয়মিত হতে শুরু করে। এবং মাস তিনেকের মধ্যে সে স্কুলে আসা বন্ধ করে দেয়। পরে জানতে পারি, সে তার এলাকার অন্য একটা স্কুলে ভর্তি হয়েছে, যেখানকার অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী হিন্দু সম্প্রদায়ের।
আমি, এই কথাটা আজকের আগে কোনদিন কোন জায়গায় বলিনি। কারণ এ কথা বলা উচিত নয়, বা বলার মতো নয় বলেই আমার মনে হত। মনে হতো, বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না।
কিন্তু আজ মনে হয়, না বলার মত কোন কথা, এটা নয়। কারণ, আজ টেলি মেডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ায়, বলা যেতে পারে, এটাই ওপেন সিক্রেট।
কোন্ দিকে যাচ্ছি আমরা?
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন