হামাস কী সন্ত্রাসবাদী?
১৯৪৭ সালের আগের ভারতবর্ষের কথা ভাবুন। সে সময়, ইংরেজ সরকার ছিল ভারতের ওপর দখলদার শক্তি। গান্ধীবাদী কংগ্রেস ছিল গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে স্বাধীনতা সংগ্রামী। সুভাষ বসু, সূর্যসেনরা ছিলেন সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামী। একই রকমভাবে আজকের ইজরায়েল হচ্ছে প্যালেস্টাইনের দখলদার। পি এল ও-র মাহমুদ আব্বাসরা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে স্বাধীনতা সংগ্রামকারী। আর হামাস, সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভের চেষ্টা করছে।যদি সুভাষচন্দ্র বসু ও সূর্য সেনরা বিপ্লবী ও স্বাধীনতা সংগ্রামী হন, তাহলে হামাস্ কীভাবে সন্ত্রাসবাদী হয়? আমার মোটা মাথায় ঢুকছে না।
ভারতীয় মিডিয়ার পরিচালক, প্রশাসক ও অ্যাংকর — এরা, পৃথিবীর ইতিহাস বাদ দিলাম, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসও কী পড়েনি?
হয়তো কেউ কেউ বলবেন, ভারতীয় বিপ্লবীরা সাধারণ জনগণকে তো মারতেন না। কিন্তু হামাস মারছে। তাদের পণবন্দী করছে।
কথাটা সত্যি। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও সত্যি যে, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামও বর্তমান প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপট এক নয়। এবং ইসরাইল নানা অজুহাতে ফিলিস্তিনদের বিনা বিচারে বছরের পর বছর বন্দী করে রেখেছে। ইসরাইলের এই কাজ যদি অবৈধ না হয়, ফিলিস্তিন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পণবন্দী করার বিষয়টা সন্ত্রাস হয় কী করে?
প্রথমত, ভারতে ইংরেজরা অভিবাসী ছিলেন না। অর্থাৎ স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য এখানে তারা উপনিবেশ গড়ে তুলতে পারেনি। শুধুমাত্র রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করেছিল। ফলে ভারতীয় জনগনের লড়াইটা ছিল কেবলমাত্র ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে। ভারতে অভিবাসী জনগণের বিরুদ্ধে নয়। যৌক্তিক কারণেই তাই ভারতীয় জনগণ ও বিপ্লবীরা কখনোই পরস্পর পরস্পরের আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে ওঠেনি।
সেই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, কোন ভারতীয় জনগণ যখনই বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তখনই তাকে বিপ্লবীরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। একাধিক উদাহরণ রয়েছে ইতিহাসের পাতায়।
অন্যদিকে, ইজরাইল শুধু প্যালেস্টাইন শাসন, শোষণ ও নির্যাতন করছে তা নয়। এখানে অবৈধভাবে অভিবাসন ঘটিয়ে আসছে দশকের পর দশক ধরে। প্যালেস্টাইনের বিপ্লবীদের সারা পৃথিবী থেকে আসা এই অবৈধ ইহুদি অভিবাসীদের বিরুদ্ধেও লড়াই করতে হচ্ছে। কারণ, ইসরাইলের প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক নাগরিক (নারী পুরুষ উভয়ই) সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং রিজার্ভ সেনা হিসেবে নথিভুক্ত। এই জনসাধারণের একটা অংশ সেনাবাহিনী এবং পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে যৌথভাবে প্যালেস্টাইনিদের ওপর আক্রমণ ও ধারাবাহিক ভাবে নির্যাতন ও লুটপাট করে আসছে।
সুতরাং ভারতীয় বিপ্লবীদের সঙ্গে প্যালেস্টিনিও স্বাধীনতা সংগ্রামীদের যুদ্ধ কৌশল ও নীতি সব ক্ষেত্রে সমান হওয়া নয়।
ইউরোপীয়রা উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেভাবে উপনিবেশ স্থাপন এবং অভিবাসন প্রক্রিয়া চালিয়েছিল, সেই নীতি যদি ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকে করতে পারত, তবে ভারতীয় জনগণের সঙ্গে ইউরোপীয় অভিবাসীদের আনুপাতিক হার এমন একটা জায়গায় পৌঁছত যে, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের লড়াইটা শুধুমাত্র ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে হতো না, হতো ব্রিটিশ সরকারের সাথে সাথে অভিবাসিত ব্রিটিশ জনগণের বিরুদ্ধেও। আজ ইসরাইলের সাথে প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের যুদ্ধের ধরন যেমন তেমন হতে বাধ্য হত। অর্থাৎ ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের একদিকে ব্রিটিশ সরকার অন্যদিকে অভিবাসী জনগণের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে হত। এই লড়াইয়ে জিততে পারলে ভারতীয়রা এই ভূমিতে টিকে থাকতে পারতো, আর না পারলে আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীরাদের মত নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে হতো। আজকের প্যালেস্টানিয়ন আদিম অধিবাসীরা সেই অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।
ভারতীয় মিডিয়ার একটা বড় অংশ একটি হাস্যকর ব্যাখ্যা দিয়ে যাচ্ছে। আর সেটা হল তিন হাজার বছর আগে নাকি এটাই ছিল ইহুদীদের বাসভূমি। তাই এই এলাকা আসলে তাদেরই। আপাত দৃষ্টিতে যুক্তিটা বেশ জোরালো বলেই মনে হবে। কিন্তু ঐতিহাসিক বাস্তবতা অন্য রকম।
এখানেই আসবে দ্বিতীয় প্রেক্ষাপট। তিন হাজার বছর আগে এই অঞ্চল যে ইহুদীদের ভূখন্ড ছিল তার কোন ঐতিহাসিক দলিল নেই। যা আছে তা হল, পৌরাণিক কাহিনী, যার ভিত্তি হচ্ছে ইহুদীদের ধর্ম গ্রন্থের বিবরণ। এখন ধর্মগ্রন্থের বর্ননা অনুযায়ী এই অঞ্চল ইহুদি, খ্রিষ্টান ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের ধর্মগুরুদের আদিভূমি। তাই যদি হয়, তাহলে ইহুদীরা একা এই অঞ্চলের ওপর দখলদারিত্ব দাবি করে কীভাবে?
তৃতীয়ত, ধর্ম গ্রন্থের ভিত্তিতে যদি অঞ্চলের ওপর দাবির স্বীকৃতি দিতে হয়, তবে তো আজকের শ্রীলঙ্কা মুসলমনদের জন্য ছেড়ে দিতে হবে। কেননা, ইসলাম ধর্মদর্শন অনুযায়ী বর্তমান শ্রীলঙ্কা হচ্ছে পৃথিবীর আদি পিতা আদমের আবির্ভাব স্থল। এখান থেকেই মুসলমান সম্প্রদায়ের উৎপত্তি ও সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ার সূচনা। সারা পৃথিবীতে বিশেষ করে, পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিস্তীর্ণ ভূভাগে যে কোটি কোটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা যদি দাবি করে তাদের ধর্মের উৎপত্তি হচ্ছে ভারত বর্ষ এবং সেই ভারতবর্ষকে তাদের জন্য ছেড়ে দিতে হবে, তা কী এই মিডিয়া কর্তারা মেনে নেবেন?
চতুর্থত, তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেই ওটা ইহুদীদের বাসভূমি ছিল। তাহলেও কী তারা আজ এই এলাকায় দখলদারিত্ব দাবি করতে পারে? আজ কেউ যদি একদেশ থেকে অন্য দেশে চলে যায় এবং ৫০ বছর পর এসে দাবী করে এই দেশ আমার জন্মভূমি ছিল, তাই এর ওপর অধিকার একমাত্র আমার, তা কি গ্রহনযোগ্য। প্রাচীন ও মধ্যযুগের আইন অনুযায়ী তো এর কোন স্বীকৃতিই নেই। আধুনিক আইন কি স্বীকৃতি দেয়? না দেয় না।
পঞ্চমত, যদি ধরে নেই মুসলিম শাসকরা এই দেশ দখল করার পর ইহুদীদের জোর করে ধর্মান্তরিত করে এবং বাকি যারা ধর্ম ত্যাগ করতে রাজি হয় নি তারা এখান থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। এখন প্রশ্ন হল যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এই দেশে থেকে গেল হাজার হাজার বছর ধরে এই ভূমির ওপর তাদের অধিকার নষ্ট হয় কীভাবে? কোন যুক্তিতে? যারা চলে গেলেন, তারা তো তাদের মাতৃভূমি বা পিতৃভূমির চেয়ে ধর্মকেই বেশি ভালোবেসেছেন। তাই এই ভূমিকে ছেড়ে তারা চলে গেছেন। সেই ভূমির ওপর কোন্ যুক্তিতে তাদের অধিকার থাকে?
তাহলে প্যালেস্টাইনকে ভালোবেসে যারা হাজার হাজার বছর ধরে এই ভূমিতেই থেকে গেলেন এবং সেই ভূমি যখন বিদেশীদের দ্বারা দখল হয়ে যাচ্ছে তখন তার বিরুদ্ধে তারা যে লড়াই করছেন তা সন্ত্রাসবাদ হয় কী করে? ইসরাইলের ইহুদি জনগোষ্ঠী যদি অবৈধ দখলদারিত্ব রক্ষায় অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে, তবে মাতৃভূমিকে রক্ষায় এবং হাজার হাজার বছর ধরে আগলে রাখা ভূমির দখল ধরে রাখার জন্য অস্ত্র ধরলে তা সন্ত্রাস হয় কীভাবে? আমেরিকার জন্ম হয়েছে রেড ইন্ডিয়ানদের ওপর নির্মম সন্ত্রাস চালানো ও পৃথিবী থেকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার মধ্য দিয়ে, তারা কোন্ মুখে হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে?
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন