তিলোত্তমা মজুমদার কি একজন বুদ্ধিজীবী?
ভালো গল্প লিখতে পারাটা পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে উঠতে পারার কোন আবশ্যকীয় পূর্বশর্ত নয়। সুতরাং অবাক হবার কিছু নেই। তিলোত্তমা মজুমদার যা বলেছেন, অনেক সাধারণ মানুষ অহরহ একথা বলে থাকেন। এবং মনে রাখতে হবে, এভাবে যারা বলেন, তারা সবাই শিক্ষিত মানুষ। আমি যদিও তাদের ‘তথাকথিত শিক্ষিত’ বলি। এ ধরনের মানুষরা, হিন্দু হলে মুসলমানের বিরুদ্ধে বলেন, মুসলমান হলে হিন্দুর বিরুদ্ধে বলেন। উপমহাদেশ জুড়েই এরা এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। উপমহাদেশ ছড়ালেই শুধুমাত্র সম্প্রদায়টা পাল্টে যায়। কিন্তু তারাও বলে। সুবিধাবাদী রাজনীতির এটা একটা শক্তিশালী অস্ত্র। তাই এটা বন্ধ করা কঠিন।
সুতরাং তিলোত্তমা মজুমদার এমন আহামরি কিছু বলেননি। অনেকেই ভাবছেন, তিলোত্তমা মজুমদার তো সাধারণ মানুষ নন। তাঁর কথা উপেক্ষা করি কী করে?
তাহলে আপনি কি করবেন? রেগে যাবেন! গালাগালি করবেন? হুমকি দেবেন! দুশ্চিন্তায় পড়বেন! আমার কেমন জানি মনে হচ্ছে, এগুলোর কোনটারই প্রয়োজন নেই। এদেরকে উপেক্ষা করুন। এবং যে উপেক্ষা করছেন, সেটা নির্দ্বিধায় এবং জোর গলায় বলুন এবং মানবিক ভাষায় বলুন। না হলে আপনার কথা গুরুত্ব হারাবে।
রেগে যে যাবেন না, তার কারণ, পৃথিবীজুড়ে মানুষের মধ্যে এই একটাই আবেক আছে, যা তার খারাপ ছাড়া, ভালো করে না। অন্য যে সব আবেগ সঙ্গে করে আমরা বাঁচি, তাদের ভালো-মন্দ দুটো দিকই আছে। বুদ্ধিমান মানুষেরা ভালো দিকটা সংরক্ষণ করেন। খারাপটাকে বর্জন করেন। তাই রাগার দরকার নেই। দুনিয়ার সব সংখ্যালঘুদের মনে রাখা উচিত, রেগে গিয়ে ধ্বংসাত্মক আন্দোলন নয়, আধুনিক শিক্ষা অর্জন আর বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে গণতান্ত্রিক পথ অবলম্বনের মাধ্যমেই একমাত্র তারা তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। সবলের বিরুদ্ধে দুর্বলের এটাই একমাত্র শক্তিশালী অস্ত্র। এর কোনো বিকল্প নেই। দোদন্ডপ্রতাপ ব্রিটিশ সরকারকে ভারতীয় জনগণ এভাবেই নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছিলেন। পৃথিবীতে সবচেয়ে নির্যাতিত জনজাতি ইহুদীরা এভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আমেরিকান সরকারের নীতি নির্ধারক এখন তারাই। সেখানে আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ আর গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলন করেই তাঁরা নিজেদের এই ক্ষমতা অর্জনে সক্ষম করে তুলেছে।
দুনিয়ার সব সংখ্যালঘুদের মনে রাখা উচিত, রেগে গিয়ে ধ্বংসাত্মক আন্দোলন নয়, আধুনিক শিক্ষা অর্জন আর বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অবলম্বন— এই দুই মাধ্যমেই একমাত্র তারা তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে।
পড়ে থাকলো দুশ্চিন্তার কথা। ভেবে দেখলাম, দুশ্চিন্তা করার মতও কিছু নেই এখানে। কারণ, আগেই বলেছি, তিলোত্তম মজুমদার ভালো গল্প লেখেন। আর গল্প লিখতে পারাটা পূর্ণাঙ্গ মানুষ অথবা বুদ্ধিজীবী হওয়ার কোন পূর্বশর্তই নয়। যদি তিনি পূর্ণাঙ্গ মানুষ বা বুদ্ধিজীবী হতেন, তবে বিষ ওগরাতেন না। তাঁর তৃতীয় নয়ন বলে দিত, কোন বিশেষ সম্প্রদায়কে এভাবে বলা যায় না। এ সমস্যা প্রত্যেক সম্প্রদায়ের, (হিন্দু মুসলিম খ্রিস্টান বৌদ্ধ ...) মধ্যেই রয়েছে এবং এর জন্য দায়ী সুবিধাবাদী রাজনীতিকরা। তারা সাধারণ মানুষকে ভুল বুঝিয়ে তাদেরকে বিপদগামী করে এবং সন্ত্রাসের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করে। এবং তাদের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। কারণ, সন্ত্রাস সৃষ্টি করতে গাধাখানি মানুষের প্রয়োজন হয় না। আজকের যুগে তো নয়ই।
আসলে বুদ্ধিজীবী শব্দটা সাধারণ মানুষের কাছে এক বিশেষ রকম অর্থ নিয়ে আসে। প্রকৃত বুদ্ধিজীবী মানুষের কাছে এই শব্দটাই আবার অন্য অর্থ বয়ে আনে। এই অর্থের দিক থেকে বুদ্ধিজীবী দু প্রকার।
একপ্রকার হল তারা, যারা বুদ্ধি বিক্রি করেন এবং জীবিকা নির্বাহ করেন। তাঁরা অন্য কোন কাজ করেন না। তাই জীবিকা অর্জনের জন্য নিছক একজন শিল্পী হিসাবেই সারা জীবন কাজ করে যান। পয়সা দিলে এরা খরিদ্দারের চাহিদা মতো শিল্প সৃষ্টি করেন। এবং বেচে দেন।
আরেক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী আছেন। তাঁরা আসলে বিদ্যা-বুদ্ধিরচর্চা করেন। বিদ্যার সঙ্গে বুদ্ধি মিশিয়ে জগতের রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করেন। তাঁদের প্রধান লক্ষ্য থাকে মানুষের কল্যাণ, মানুষের মুক্তি, মানুষের ভালো। এরাই প্রকৃত বুদ্ধিজীবী।
এইসব (দ্বিতীয় শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীর) মানুষদের, সাধারণ মানুষের মতোই দুটো চোখ আছে। কিন্তু চেতনার অভ্যন্তরে আছে আরেকটি চোখ। আপনি তাকে ‘তৃতীয় নয়ন’ বলতে পারেন। এটা যাদের আছে, তাঁরা সাধারন মানুষ যা দেখেন এবং বোঝেন, সেটা তো তাঁরা দেখতে পানই, তার বাইরেও অনেক কিছু দেখতে পান। বুঝতে পারেন দৃশ্যমান জগতের বাইরেও অনেক কিছুই ঘটছে, যা সাধারণ মানুষ দেখতে বা বুঝতে পাচ্ছেন না। এই ক্ষমতা যাদের আছে, তারাই আসলে বুদ্ধিজীবী। এঁরা অর্থের জন্য বুদ্ধির চর্চা করেন না। করেন জ্ঞানান্বেষণের ক্ষুধায়। ইতিহাসের পাতায় তারা কেউ বিজ্ঞানী, কেউ দার্শনিক খ্যাতি নিয়ে বেঁচে থাকেন। তবে হ্যাঁ, বেঁচে থাকার জন্য নূন্যতম অর্থ বিনিময় মূল্য হিসাবে পেলে, তাঁরা তা নেন। কিন্তু না পেলে, থেমে যান না। এটা তাঁদের কাছে একটা নেশার মত। জ্ঞানের নেশা, মানুষের ভালোর জন্য কাজ করার নেশা। এদের মধ্যে হিংসা থাকেনা, লোভ থাকেনা, থাকেনা মোহ। এঁরা মানুষের মধ্যে জাত বিভাজন খোঁজেন না।
তিলোত্তমা মজুমদার খুবই সুন্দর গল্প লেখেন। কিন্তু বুদ্ধিজীবী হওয়ার শর্তগুলোর কোনটাই তিনি অর্জন করেছেন বলে মনে হয় না। সুতরাং তাঁর কথার প্রভাব আহামরি কিছু নয়। একজন সাধারণ মানুষের মতোই তিনি এ কথা বলেছেন। এই অল্প সংখ্যক সাধারণ মানুষ কিছুই করে উঠতে পারবেন না, যদি বেশিরভাগ মানুষ তার যুক্তি, বুদ্ধি এবং তথ্যের বিচারে সিদ্ধান্ত নেন। তাই আপনার দায়িত্ব রেগে যাওয়া না; যুক্তি, বুদ্ধি এবং তথ্য দিয়ে তাঁর বক্তব্য যে ‘বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ (প্রথম শ্রেণির বুদ্ধিজীবীর মতো) এবং ভ্রান্ত, তা প্রমাণ করতে মুখ খোলা।
---------xx--------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন