পুঁজিবাদের প্রধান হাতিয়ার বা অস্ত্র :
The main tool of capitalism
Prantik Ghosh পুঁজিবাদের প্রধান দুটি অস্ত্র হল, সাম্রাজ্যবাদ ও মৌলবাদ। কারণ, শ্রমের শোষণ ছাড়া পুঁজি জমে না। আর শোষণের প্রধান হাতিয়ার হল এই দুটি অস্ত্র।সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা ইত্যাদি আধুনিক ও উন্নত ধ্যান ধারণার আড়ালে পরোক্ষ সাম্রাজ্যবাদ কায়েম করে। অর্থনৈতিক দিক থেকে দেখলে, এরা খোলা বাজার (উদার) অর্থনীতির নাম করে শোষণের রাস্তাকে একতরফা করে নিতে চায়। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা সহ ইউরোপীয় দেশগুলোর পুঁজিবাদী রাজনৈতিক দলগুলোর সবাই সাম্রাজ্যবাদী। কেউ ঘোর সাম্রাজ্যবাদী, কেউ একটু নরমপন্থী।
 পুঁজিবাদ এ-দুটোকে ছাড়া বাঁচে না। তাই তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থে যখন যেটা প্রয়োজন হয়, সেটাই প্রয়োগ করে। আর মৌলবাদীরা সেকুলারিজমকে পছন্দ করে না, ঘেন্না করে। যারা সেকুলারিজমকে ঘেন্না করে এবং পুঁজিবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে, তাদের সঙ্গে এদের সম্পর্ক খুবই মধুর। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের বর্তমান সরকারের দহরম মহরম সম্পর্ক একারনেই তৈরি হয়েছে। নরেন্দ্র মোদিকে সংযুক্ত আরব আমিরাত মন্দির তৈরি করার জন্য ২৭ একর জমি দান করেছেন, সেকুলারিজম-এর স্বার্থে নয়, পুঁজিবাদের স্বার্থে।
প্রসঙ্গ জানতে এখানে ক্লিক করুন।
Ali Hossain কিন্তু পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সব মানুষের সমান ও সরল অধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার তো ইসলাম ধর্মে মান্য। তাহলে কি পুঁজিবাদের চাকরবৃত্তি করার সুবিধাবাদী মোহ কাগজে-কলমে ইসলামিক দেশগুলোকে আসলে নন-ইসলামিক মান্যতার পথে নিয়ে গেছে?
দ্বিতীয়ত, নারীদের স্বাধীন মতপ্রকাশের তথা মতপালনের অধিকার, শিক্ষা ও সামাজিক ক্ষেত্রে পুরুষের সমান বা অধিক গুরুত্ব নিয়ে এগিয়ে আসার অধিকার তো পুঁজিবাদী দেশগুলোতেও বেশ সচল। তাহলে পুঁজিবাদের দোসর হয়েও ইসলামিক দেশগুলোতে সেই অধিকার অস্বীকৃত বা বিরোধিতাময় কেন?
ধর্মের সঙ্গে পুঁজিবাদের সম্পর্ক :
Prantik Ghosh একদমই তাই। হযরত মুহাম্মদ-এর মৃত্যুর পর যে চারজন খলিফা প্রশাসনিক দায়িত্বে এসেছিলেন তারা ইসলামের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, ও ধর্মীয় দর্শন ঠিকঠাক অনুসরণ করেছিলেন। এই সময়কালকে আরব ইতিহাসে ‘খেলাফায়ে রাশেদীন’ (মহান ও পবিত্র খলিফাদের যুগ) নামে অভিহিত করা হয়। এই চারজন খলিফা হলেন—হযরত আবু বকর (৬৩২ - ৬৩৪), হযরত ওমর ফারুক (৬৩৪ - ৬৪৪), হযরত ওসমান গনি (৪৪৪ - ৬৫৬), এবং হযরত আলী (৬৫৬ - ৬৬১)। মূলত কোরআন এবং হযরত মুহাম্মদ-এর কাছ থেকে নিজ কানে শোনা বিভিন্ন নীতি ও নির্দেশিকা অনুসরণ এবং নিজেদের বিচারবুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে তারা ইসলামিক প্রজাতন্ত্র নামে এক ধরনের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন। গণতান্ত্রিক বলছি এই কারণে, যে তখনও আরব ভূমিতে রাজতন্ত্রের আবির্ভাব হয়নি। শাসক মূলত নির্বাচিত হতেন। 
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, হযরত মুহাম্মদ-এর উত্তরসূরি ছিলেন তাঁর জামাই হযরত আলী। হযরত মুহাম্মদ ইচ্ছা করলেই তাঁকে শাসক হিসেবে মনোনীত ও নিয়োগ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। শাসক নিয়োগে নির্বাচনকেই তিনি প্রকৃত পথ হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। 
কিন্তু এই চারজন খলিফার পর যাঁরা ক্ষমতায় এসেছিলেন তাঁরা এই নির্বাচনের পথ পরিত্যাগ করেন। ইসলাম ধর্ম ও শাসনের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার কারণে, প্রথমদিকে যারা হযরত মুহাম্মদকে এবং তাঁর ধর্ম ও শাসনকে মানতে পারেননি, তাঁরাও এই ধর্মের অনুসারী হয়ে ওঠেন। এবং ক্রমশ প্রশাসনিক ক্ষেত্রে নিজেদের আধিপত্য কায়েম করে ফেলেন। মূলত, তাদের দ্বারাই আরবের ইসলামিক রাজ্য ‘সাম্রাজ্যে’ পরিণত পরিণত হয়েছিল। সেইসঙ্গে খলিফা পথকে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রে পরিণত করে। এক্ষেত্রে ঘুমাইয়া বংশের শাসক মুয়াবিয়ার উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।
তবে এ কথাও ঠিক যে, এই সাম্রাজ্যিক পর্বের কোন কোন শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় আরবীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি গৌরব উজ্জ্বল পর্বে প্রবেশ করে। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল আব্বাসীয় রাজবংশ। কিন্তু রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ক্রমশ স্বৈরতান্ত্রিক রাজতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এই পর্বেই সাম্যবাদকে সরিয়ে ক্রমশ পুঁজিবাদের প্রবেশ ঘটে বা বলা ভালো ঘটানো হয়। 
হযরত মুহাম্মদের মৃত্যুর প্রায় ৩০০ বছর পর কোরআনকে পাশ কাটিয়ে স্বৈরতান্ত্রিক রাজতন্ত্রকে সুরক্ষিত করার জন্য শাসকের মনোনীত আলেম এবং উলেমাদের দিয়ে সংকলিত হতে থাকে একের পর এক হাদিস এবং শরীয়ত। ঠিক যেভাবে পরবর্তী বৈদিক যুগে (১০০০-৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ঋগ্বেদকে পাশ কাটিয়ে নতুন তিনটি বেদ তৈরি করা হয়েছে। এবং পরবর্তীকালে তৈরি হয়েছে ১৮ টি পুরান শাস্ত্র। সাম, যজু ও অথর্ব বেদের বিষয়বস্তুর দিকে লক্ষ্য দিলেই বোঝা যায় এদের মাধ্যমে আর্যদের ধর্মীয় জীবনে নানা পরিবর্তন আসতে শুরু করে, যার সঙ্গে রাজনীতির যোগ রয়েছে। এই সময়ই শুরু হচ্ছে যাগযজ্ঞ, মূর্তি পূজার ব্যাপকতা, পুরোহিতদের প্রাধান্য এবং বৃদ্ধি পাচ্ছে ধর্মীয় জটিলতা।
ঋগ্বেদ মূলত মন্ত্র প্রধান গ্রন্থ। এবং এর বিষয়বস্তু হলো প্রাকৃতিক শক্তির বর্ণনা ও তাঁর উপাসনার মন্ত্র। এই মন্ত্রপাঠ এবং ধ্যানের (গবেষণা) মধ্য দিয়ে ঈশ্বর এবং ঈশ্বরের সৃষ্টিকে জানা ও বোঝার চেষ্টা ছিল এই মন্ত্রপাঠের মূল উদ্দেশ্য। খানিকটা আধুনিক গবেষণার প্রাথমিক রূপের সঙ্গে তুলনীয়। 
অন্যদিকে সামবেদ মূলত সংগীতপ্রধান গ্রন্থ। সুর ও ছন্দ মিলিয়ে লেখা এই স্তোত্রগুলোর (সামগান) মাধ্যমে দেবতাকে খুশি করাই ছিল এর মূল লক্ষ্য এবং প্রার্থনার (উপাসানা নয়) মধ্য দিয়ে সহজেই ইচ্ছা পূরণই হল এর উদ্দেশ্য। এই লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য পূরণের জন্য সামবেদে দেবতার উদ্দেশ্যে যাগযজ্ঞের করার বিধান দেওয়া হল। এভাবে কঠোর উপাসনা বা তপস্যার জায়গা দখল করে নিল যাগযজ্ঞের মত একটি সহজ পন্থা যা অর্থ থাকলেই করা যায়। অর্থাৎ উপাসনার জায়গা নিয়ে নিল প্রার্থনা।
যজুর্বেদে এসে আরও একধাপ এগিয়ে যাগযজ্ঞের বর্ণনা ও বিধান বিস্তারিত করা হলো। যজুর্বেদ তাই মূলত যাগ-যজ্ঞের বর্ণনাপ্রধান গ্রন্থ।
অথর্ব বেদের বিষয়বস্তু হলো সামাজিক নিয়ম কানুন যা সাধারণ মানুষকে মেনে চলতে হয়। বিবাহের নিয়ম কানুন, রোগ মুক্তির উপায়, মৃতদেহের সৎকার করার পদ্ধতি, জাদুবিদ্যার মাহাত্ম্য ইত্যাদি। অর্থাৎ এই গ্রন্থের মাধ্যমে মানুষের ধারণায় ঢুকিয়ে দেওয়া হলো কর্মফল ও অলৌকিক শক্তির কথা। জন্ম নিল পূর্বজন্মের কৃতকর্মের ফল ভোগের ধারণা। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা, পাওয়া-না-পাওয়ার ব্যাখ্যায় ঢুকে গেল পূর্বজন্মের কর্মফলে তত্ত্ব। জন্ম হলো জন্মান্তরবাদ। বলা হলো, এই কর্মফল ও জন্মান্তরের হাত থেকে মানুষের কোন মুক্তি নেই। এই এই পরিস্থিতিতে মানুষের শান্তির একমাত্র পথ সন্ন্যাস গ্রহণ।
এভাবে ধর্মের মধ্যে অবতারবাদ, তন্ত্র, মন্ত্র, যাদু, ইন্দ্রজাল ইত্যাদি প্রবেশ ঘটলো। মজার কথা হল, এসবই হল রাষ্ট্রীয় মাদতে শাসকের স্বৈর-ক্ষমতাকে কন্টকমুক্ত ও নিরঙ্কুশ করার লক্ষ্যে। দীর্ঘ জীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে একজন মানুষ জগৎ ও জীবন সম্পর্কে যে জ্ঞান ও সত্য উপলব্ধি করে, তাকে চীরতরে নির্বাসন দেয়ার, এ এক অভিনব পন্থা।
ইসলাম ধর্মের ধর্মগ্রন্থ কোরআন। এখানে ধর্ম পালনের বিধান আছে। বৈদিক ধর্মের ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদ। সেখানেও বৈদিক ধর্ম পালনের জন্য যাবতীয় বিধান আছে। বস্তুত, ধর্ম পালনের জন্য এই দুটোই যথেষ্ট। মজার কথা হলো, এই গ্রন্থ দুটির মধ্যে আপনি যুক্তিবাদী চিন্তাভাবনা এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রাথমিক পর্বের রসদ খুঁজে পাবেন। এই গ্রন্থগুলোর প্রভাবেই পরবর্তীকালে (গুপ্ত যুগে) আমরা আর্যভট্ট, বরাহমিহির, ব্রহ্মগুপ্ত, বাগভট্টকে পেয়েছি; মধ্যপ্রাচ্য পেয়েছি  ইবনে বাশাল (জ্যোতির্বিদ্যা), আবু জায়েদ আল বালকি (ভূগোল), আল খোয়ারিজমি, আভিসেনা (গণিত), ইবনে আল-হায়থাম (জ্যোতির্বিদ্যা, আলোকবিদ্যা) প্রমূখ বিজ্ঞান গবেষককে।
কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে, স্বৈরশাসকদের ধর্মকে ব্যবহার করার প্রবণতা বাড়ে। কারণ, ধর্ম দিয়ে মানুষকে সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আর এই প্রবণতার ফল হল, মুসলিম সমাজেও বেশ কিছু হাদিস ও অসংখ্য শরীয়তের (যেগুলো মুসলিম সমাজে ‘ইজমা’, ‘কিয়াস’, ‘ইজতেহাদ’ নামে পরিচিত) আবির্ভাব, ঠিক যে কারণে বৈদিক সমাজে (আমরা যাকে হিন্দু বলি) ইতিপূর্বেই জন্ম নিয়েছে সামবেদ, যজুর্বেদ এবং অথর্ববেদ। পরবর্তীকালে রামায়ণ মহাভারত সহ ১৮ টি পুরান গ্রন্থ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন