প্রসঙ্গ : ৩% অন্য ধর্মকে নিয়ে নিরপেক্ষতা প্রমান এবং পালন প্রশ্ন চিহ্ন রেখে যেতে পারে - সুকুমার বর্মন
প্রশ্নচিহ্ন ওঠাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। পৃথিবীর এমন কোন দেশ নেই, যার বিরুদ্ধে (শাসকের বিরুদ্ধে) প্রশ্ন চিহ্ন নেই, এমন দাবী করা যাবে। গণতন্ত্র, রাজতন্ত্র, সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র ইত্যাদির যেকোন রাষ্ট্রদর্শনকে অবলম্বন করে পৃথিবীব্যাপী যে রাষ্ট্রব্যবস্থা বা সরকার চলছে তার কোনটাই প্রশ্নশূন্য নয়। প্রত্যেকটা দেশের বিরুদ্ধে কোন না কোন অভিযোগ বিপক্ষ শিবিরের লোকজন করে থাকে। সুতরাং 'প্রশ্ন তোলার সম্ভাবনা থেকে যেতে পারে' বলার মধ্যে কোন বিশেষ বার্তা নেই। যা আছে, তা সাধারন। কোন কোন দেশের ক্ষেত্রে তা অতি সাধারণ।
সুতরাং প্রশ্ন তোলার ক্ষেত্রে ধর্মটা এবং তার পার্সেন্টেজটা (৩%) কোন গুরুত্ব বহন করে না। কারণ, একটা রাষ্ট্র ব্যবস্থা, সে ধর্মনিরপেক্ষ হবে, না ধর্মীয় শাসন নীতি মেনে চলবে, তা পার্সেন্টেজ এর উপর নির্ভর করে চলেনা। তা যদি হতো, তাহলে :
১) ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার সাথে সাথে হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে আত্ম প্রকাশ করত।
২) বর্তমান বাংলাদেশ সংবিধান থেকে 'রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম' বলে যে শব্দবন্ধটি লিপিবদ্ধ আছে ( যা সামরিক শাসক তার অবৈধ ক্ষমতা দখলকে বৈধতা দেওয়া বা টিকিয়ে রাখার জন্য ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সংবিধানে ঢুকিয়েছিলেন) তার বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং মামলা হত না।
৩) ইউরোপ এবং আমেরিকাসহ অধিকাংশ দেশের রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে খ্রিস্টান ধর্ম স্বীকৃতি লাভ করত। (কারণ সেখানকার অধিকাংশ মানুষের ধর্ম খ্রিষ্টান । ) ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রনীতির জন্মই হতো না।
৪) সবচেয়ে বড় কথা, মধ্যপ্রাচ্যের এবং আফ্রিকার হাতেগোনা কয়েকটি দেশে রাষ্ট্রধর্মের (ইসলাম) স্বীকৃতি রয়েছে। ওই অঞ্চলের অধিকাংশ দেশের সংবিধানে তা অনুপস্থিত রয়েছে - এটা সম্ভব হত না।
লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাব, যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সাম্রাজ্যের ধারণা ভেঙে গিয়ে জাতিরাষ্ট্রের ধারণার উৎপত্তির সাথে সাথে মধ্যপ্রাচ্যের এবং আফ্রিকার অধিকাংশ দেশে ধর্মীয় বিধান মেনে শাসন করার পাঠ একটু একটু করে উঠে যেতে শুরু করে। ইরান, সৌদি আরব এবং সুদান ছাড়া আর কোনো উল্লেখযোগ্য দেশ কঠোরভাবে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বারবার চেষ্টা চলেছে ইসলাম নির্ধারিত শাসন নীতি মেনে অর্থাৎ রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে স্বীকৃতি দেয়ার চক্রান্ত করার। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা ব্যর্থ হয়েছে। সর্বশেষ উদাহরণ সুদান। সুদানের পিপলস লিবারেশন মুভমেন্ট গ্রুপের নেতা আব্দেল আজিজ আল হিলু এবং প্রধানমন্ত্রী আব্দুল্লাহ হামদোক ৩ সেপ্টেম্বর চুক্তির মাধ্যমে সুদানকে এবং তার নতুন সংবিধানকে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক ও বৈষম্যমুক্ত করা এবং রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে আলাদা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। সুতরাং ইসলামপন্থীরা পুরোপুরি এই মুহূর্তে ব্যর্থ তা স্বীকার করতেই হবে।
তবে এ কথা ঠিক, যে ইসলামপন্থীরা এই ব্যর্থতা অন্তর থেকে মেনে নেবে না। সুতরাং প্রশ্ন থেকেই যায় যে এই ব্যবস্থা কতদিন টিকবে। আমি আগেই উল্লেখ করেছি যে, পৃথিবীর কোন রাষ্ট্র ব্যবস্থাই প্রশ্নচিহ্নের উর্ধে নয়, এবং তা অনন্তকাল থেকে যাবে, তাও হতে পারে না। যুগের পর যুগ তা নির্দিষ্ট একটি চেহারায় নিজেকে টিকিয়ে রাখবে একথাও ইতিহাস সম্মত নয়, এমন কি হতেও পারে না।
প্রশ্ন হল, ইসলামপন্থীদের এই ব্যর্থতাকে আমরা কীভাবে দেখব? কোন প্রশ্ন দিয়ে এই অবস্থাকে বিচার করার চেষ্টা করব?
আমার দৃষ্টিভঙ্গিতে মনে হয়েছে এই ধরনের প্রশ্নকে গুরুত্ব দেয়া অমূলক। এটাকে আমাদের অবশ্যই ইতিবাচক পদক্ষেপ বা বিষয় হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া উচিত। কারণ, এখানকার রাষ্ট্রনেতারা, মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রনীতি থেকে বেরিয়ে আধুনিক রাষ্ট্রদর্শনকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন বা দিতে চলেছেন। তাই প্রশ্ন তোলা গেলেও লক্ষ্য রাখতে হবে যে, এই প্রশ্ন যাতে এই শুভ প্রচেষ্টাকে ছোট করে দেখানোর বা গুরুত্বহীন করে দেখানোর চেষ্টা না হয়ে যায়।
আর একটা দিক থেকেও এই ঘটনা আমার কাছে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থার সঙ্গে তুলনা করলে বিষয়টি পরিস্কার হয়ে ওঠে। আমাদের দেশের সরকার যেখানে আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থাকে দীর্ঘদিন লালন-পালন করার পর বর্তমান সরকার এবং তার অনুগামীরা মধ্যযুগীয় রীতিনীতিকে অনুসরণ করে ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র করার চেষ্টা করছে, এবং মুসলিম প্রধান দেশগুলির কথা উল্লেখ করে তার বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করছে, সেখানে সুদানে ঘটছে ঠিক তার উল্টো প্রক্রিয়া। অর্থাৎ সুদান অন্ধকার থেকে আলোর দিকে আসার চেষ্টা চালাচ্ছে আর আমরা আলো থেকে অন্ধকারের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছি। এটা জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে আমাদের চিন্তা চেতনার দৈন্যতাকে নগ্নভাবে প্রকাশ করছে। অর্থাৎ আমরা পিছন দিকে হাঁটছি।
আমার এই পোষ্টের উদ্দেশ্য হচ্ছে এই আলো আঁধারের বিপরীতমুখী প্রবাহের মধ্যে যে 'এগিয়ে আসা ও পিছিয়ে যাওয়া'র ঘটনাটি ঘটছে তা মানুষের সামনে তুলে আনা এবং আঁধারের অভিমুখে যাওয়া যাত্রীদের অনৈতিক ও অনৈতিহাসিক অভিযোগের বিরুদ্ধে উপযুক্ত উত্তর ও উদাহরণ উপস্থাপন করা। সোজা কথায় ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সংবিধানের বিরুদ্ধে ভক্তবৃন্দের প্রধান অস্ত্র যে অযৌক্তিক ও মিথ্যা তা মানুষের কাছে তুলে ধরা।
আমি আবুল ফজলের একটি মন্তব্যের ওপর ভাবনা নিয়ে বলেছিলাম।তাঁরমতে 'আজ কেতাবের ইসলাম আর মানবতার ইসলামের মধ্যে প্রশান্ত মহাসাগর বিরাজমান।' এটি সমস্ত ধর্মের মানুষের মৌলিক সমস্যা। মানবতার জয় আমি ও চাই।তবে ধর্মের কারাগার থেকে মুক্ত কষ্টকর।
উত্তরমুছুননিঃসন্দেহে কষ্টকর। তবে আমরা আশাবাদী। ইউরোপ যখন পেরেছে আমরাও পারব। পারতে আমাদের হবেই। আজ হোক আর আগামীতে হোক। লড়াইটা জারি রাখতে হবে।
মুছুনআচ্ছা আমি কি সুকুমার বর্মনের সঙ্গে কথা বলছি?