Pritam Roy মধ্যযুগের ইসলামিক শাসকদের দয়া-দাক্ষিণ্যে হিন্দুরা টিকে ছিল এ কথা কেউ বলে না। এই প্রথম আপনার মুখ দিয়ে শুনলাম।
১) মধ্যযুগের ইসলামিক শাসকরা মানবিক মূল্যবোধ, সাম্যবাদী মনোভাব নিয়েই এদেশে এসেছিলেন। এই মনোভাবের মূল কথাই হচ্ছে মানুষের মানুষের বিভেদ নয় পারস্পরিক সহমর্মিতা ই মানুষের আসল ধর্ম। এই মতের বিশ্বাসই তাদেরকে মানবিক করে তুলেছিল। অমানবিক কোনো সিদ্ধান্ত তাঁরা নেন নি। এটাই টিকে থাকার অন্যতম প্রধান কারণ।
২) ভারতবর্ষের অধিকাংশ সামন্ত প্রভুরা হিন্দু ছিলেন। কেন ছিলেন? কারণ মুসলিম শাসকদের মধ্যে ধর্ম নিরপেক্ষ ভাবনা আগাগোড়াই কার্যকর ছিল। তাই রাজ্য জয় করার পরও হিন্দু প্রশাসক নিয়োগ করেছিলেন। যে সমস্ত হিন্দু প্রশাসন তাদের বশ্যতা স্বীকার করেনি, তাদের সরিয়ে বিশ্বস্ত লোককে প্রশাসক নিয়োগ করার প্রচুর উদাহরণ আছে। সুতরাং আপনার যুক্তি যথাযথ নয়।
৩) মারাঠা থেকে শুরু করে সারা ভারত জুড়ে হিন্দু শাসক গোষ্ঠীর মধ্যে যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ছিল তা অস্বীকার করার চেষ্টা করাটা খুবই হাস্যকর। ভারতের হিন্দু শাসকরাই তার প্রতিবেশী শাসককে আবার কখনো কখনো নিজের রাজ্যের প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার জন্য মুসলিম শাসকদের ডেকে এনেছেন। এ তথ্য অজানা নয়। সুতরাং আপনার প্রথম যুক্তি মোটেই সমর্থনযোগ্য নয়।
৪) যে আওরঙ্গজেব কে উদ্ধত্য কারি বলে ব্যাখ্যা দিলেন সেই শাসকের আমলে কিন্তু আসমুদ্রহিমাচল একসূত্রে বাঁধা পড়ে ছিল। ভারতীয়ত্বের যে ধারণা নিয়ে আজ আমরা গর্ব করি সেই ধারণাকে বাস্তব রূপ দিয়েছিলেন সেই ঔরঙ্গজেবই। এর আগে আলাউদ্দিন খলজী এই কাজটা খানিকটা করতে পেরেছিলেন। প্রাচীন ভারতে একমাত্র সমুদ্র গুপ্ত ছাড়া এ কাজে কেউই এতোটুকু এগোতে পারেননি। আজকের যে ভারতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে তার বাস্তব চেহারা প্রাচীন ভারতের ছিলনা। অসংখ্য ছোট ছোট রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল এই ভূখণ্ড। ইতিহাস বলছে, এমনকি দোদণ্ডপ্রতাপ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিও এই উপমহাদেশকে একসূত্রে বাঁধতে পারেনি। ব্রিটিশ ভারতের মানচিত্র দেখলে আপনার কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। স্বাধীনতার পর এই কাজটা সম্পন্ন করেছে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস।
৫) অন্যদিকে ঔরঙ্গজেবের আমলের ভারতীয় মানচিত্রের দিকে একবার তাকান। দেখবেন আকবর যেখানে মূলত উত্তর ভারতে তার সাম্রাজ্যকে সীমাবদ্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছেন, সেখানে ঔরঙ্গজেব সমগ্র ভারতবর্ষকে একটি প্রশাসনিক সংগঠনের আওতায় এনে ফেলে ভারতীয়দের এক জাতি হিসাবে উপস্থিত করার প্রাথমিক কাজটি করে ফেলেছিলেন। স্বাধীনতার পর সেই কাজের পূর্ণতা দিয়েছে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস।
আমাদের দুর্ভাগ্য যে ব্রিটিশদের হাতে আমাদের ভারতবর্ষের ইতিহাস শুধু লাঞ্ছিত নয়, ধর্ষিত হয়েছে। তাই আমরা সত্য ইতিহাস থেকে দীর্ঘদিন বঞ্চিত থেকেছি।
কিন্তু সত্য চাপা রাখার কাজ খুবই কঠিন। তাই স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে বড় বড় ঐতিহাসিকদের গবেষণায় সত্য বেরিয়ে এসেছে। আরএসএস সহ হিন্দুত্ববাদীরা সেই ইতিহাস নতুন করে চাপার চেষ্টা করছে এবং ইংরেজদের তৈরি আস্তাকুঁড় থেকে ইতিহাসের সেই ধর্ষিত চেহারা নতুন করে রং মাখিয়ে ভারতমাতা হিসেবে তুলে ধরছে। আমাদের ভারতমাতাকে সেই ধর্ষিত চেহারায় আমরা দেখব কিনা তা আমাদের ঠিক করতে হবে। আমরা যদি এটা রোখার কাজে ব্যর্থ হই পরবর্তী ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। আজ যেভাবে ইংরেজ ঐতিহাসিকদের জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিক ক্ষমা করছেন না, তাদের কাঠগড়ায় তুলছেন, ঠিক তেমনি ভাবে আমাদেরকেও পরবর্তী প্রজন্ম কাঠগড়ায় তুলবে।
৬) ওরঙ্গজেব যদি অত্যাচারী হতেন, সাম্প্রদায়িক হতেন তাহলে তার আমলে সাম্রাজ্যের এই বিশাল বিস্তৃতি হলো কি করে? যদি বলেন শক্তির জোরে, তাহলে সেই শক্তি দিয়েই কি ভারতবর্ষের অসংখ্য হিন্দু মানুষকে মুসলিম করে নিতে পারতেন না? আবেগ দিয়ে ইতিহাস চর্চা হয় না। অনুমান দিযে বিজ্ঞান চর্চা কখনো কখনো হলেও ইতিহাস চর্চা কখনোই হয় না। তাই আবেগটাকে তুলে রেখে যুক্তি বুদ্ধি আর তথ্য দিয়ে আমাদের এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করতে হবে। তখন দেখবেন সব উত্তর আপনার সামনে উপস্থিত হয়েছে।
৭) আর মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য ঔরঙ্গজেব কে যেভাবে দায়ী করা হয় এটা পুরোপুরি সত্য নয়। মোগল সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছে ঔরঙ্গজেব পরবর্তী শাসকদের অযোগ্যতার কারণে। মুঘল দরবারে দলীয় রাজনীতি ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়েছিল। তাকে কন্ট্রোল করার ক্ষমতা ওরঙ্গজেব পরবর্তী শাসকদের ছিল না।
৮) ঔরঙ্গজেব যে বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী হয়েছিলেন, তৎকালীন সময়ের যোগাযোগব্যবস্থার দুর্বলতার কারণেই তিনি সারা বছর ভারতের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত ছুটে বেড়িয়েছেন। ফলে আর্থিক এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে কিছু সমস্যা তৈরি হয়েছিল যা এই বিশাল বিস্তৃতির কারণেই এবং অনুন্নত যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে ঘটেছিল।
সুতরাং গবেষকদের ইতিহাস বই পড়ুন। এছাড়া আসল ইতিহাস আপনি পাবেন না। কোন রাজনৈতিক দলের প্রচার পুস্তিকা থেকে যদি ইতিহাস জানতে চান তাহলে ভুল ইতিহাসই আপনার পথ আগলে দাঁড়াবে। আপনাকে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছতে দেবেনা।
উৎস জানতে এখানে ক্লিক করুন
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন