কথাকার নিহার চক্রবর্তী। কবিতাও লেখেন। মাঝে মাঝে রাজনীতি বিষয়ক দু একটা পোস্ট করেন। বলাই বাহুল্য রাজনৈতিক মতাদর্শের দিক থেকে উনি আর আমি সম্পন্ন দুই মেরুর মানুষ। সুতরাং মতপার্থক্য হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই মতান্তর কখনো মনান্তরের কারণ হয়ে ওঠেনি। অন্তত এখনো পর্যন্ত আমার তাই মনে হচ্ছে।
নিহার বাবুর ফেসবুকীয় বন্ধু অমিতাভ মিত্র। উনিও কবিতা লেখেন। নিহার বাবুর মত আমিও তাকে কবি হিসাবে তার প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা দিতে কুন্ঠা করিনা। যদিও ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাঁর আর আমার মধ্যে কোন জানাশোনা নেই। ফেসবুকের দৌলতে দুই একটা লেখা পড়েছি। খারাপ লাগেনি।
সম্প্রতি প্রতিদিন সংবাদপত্রে একটি খবর বেরিয়েছে। খবরটি পেপার কাটিং এখানে রাখলাম।
এই খবরটা কে উল্লেখ করে নেহার বাবু একটা পোস্ট করেছেন, যেটা বর্তমানে আমি আর খুঁজে পাচ্ছিনা। এই পোস্টে নিহার বাবু জানতে চেয়ে ছিলেন বাঙালি মুসলমানদের, বিশেষ করে শিক্ষিত মুসলিমদের মতামত। এই পোস্টে কবি অমিতাভ মিত্র মুসলিমদের সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছিলেন তা আমাকে খুবই অসম্মানিত করেছে। একজন মানুষ হিসেবে এই অসম্মান আমাকে আঘাত দিয়েছে বলতে পারেন। তিনি যে মন্তব্য করেছিলেন তার সারমর্ম হল এই রকম।
১) শিক্ষিত আর অশিক্ষিত বলে কিছু নেই। মুসলিমরা সবাই মৌলবাদী।
২) আর এরা লেখাপড়া শেখে শুধু চাকরি পাওয়ার জন্য। আত্মশুদ্ধির জন্য নয়। প্রকৃত শিক্ষা এরা কখনোই গ্রহণ করে না।
অমিতাভ মিত্র, আপনি কি করে বুঝলেন শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব মুসলমানই মৌলবাদী? আপনি কি একবারও ভেবে দেখেছেন, আপনি যেভাবে একটা সম্প্রদায়কে তুলে ধরলেন, এটার মধ্যেও রয়েছে এক ধরনের মৌলবাদ। আপনি ভেবে দেখেছেন, মুসলিম ঘরে জন্মানোর কারণে, আপনি আমাকেও কতটা অপমান করলেন? যদি না বোঝেন, তাহলে জেনে রাখুন, মৌলবাদের জন্য আপনিও দায়ী, আপনার মানসিকতাও দায়ী। কারণ, আধুনিক শিক্ষার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে যুক্তিবাদ ও মানবতাবাদ, তা আপনার মধ্যে একরত্তিও ঢোকে নি। এটা যাদের মধ্যে ঢোকেনা তারাই ধর্মব্যবসায়ীদের দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং মৌলবাদী হয়ে যায়।
আপনার কে অধিকার দিয়েছে আপনি আমাকে মৌলবাদী বললেন? যুক্তি বিজ্ঞানের কোন সূত্র প্রয়োগ করে আপনি জানলেন যে, আমি মৌলবাদী? আপনাদের এই ধরনের মানসিকতা মুসলিমদের বিপদগামী করে দিতে পারে। আপনি বোঝেন? আপনার এই ধরনের কথাবার্তাই মৌলবাদী শক্তির হাতিয়ার হয়ে ওঠে, বোঝেন?
শুনে রাখুন, যারা যুক্তি-বুদ্ধির বাইরে গিয়ে একটা সম্প্রদায়ের সমস্ত মানুষকে মৌলবাদী বলে দেয়, সে সবচেয়ে বড় মৌলবাদী। আপনি তাদেরই একটি লেখাপড়া জানা প্রজাতি। শিক্ষিত নয়।
দাদা, প্রকৃত শিক্ষা যার মধ্যে ঢোকে, তারমধ্যে মৌলবাদ প্রবেশ করে না। ধর্মান্ধতা ঢোকেনা। এটা বোঝার মত শিক্ষা কি আপনার মধ্যে আছে? থাকলে আপনার মতামতটা অন্যরকম হতো।
ভারতবর্ষে প্রচুর মানুষ আছেন, যারা এই পোস্টটা দেখছেন না। যারা দেখছেন না, তারা হয়তো মতামত দেবে না। কিন্তু আপনি তাদেরকেও মৌলবাদী বলে দিলেন। এ ধরনের কথা প্রকৃত শিক্ষিত লোকেরা বলে না।
আধুনিক শিক্ষার মূল ভিত্তি হচ্ছে যুক্তিবাদ। যুক্তিবাদ বিশ্বাসের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে। যারা আনুষ্ঠানিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম পালন করে তারা বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে সেই কাজ করে। যারা বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে থাকে, তারা নামাজ পড়ে, পূজা করে, উপরওয়ালার উপর ভরসা করে নিজের ভাগ্য ফেরাতে চায়। লেখাপড়া শেখা সত্ত্বেও যারা এই ধরনের ধর্মাচরণ করে তারা কি যুক্তিবাদী? আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ করা মানুষদের আপনি পূজা করতে দেখেন না? আপনি নিজে পূজা করেন না? তাহলে যে আধুনিক শিক্ষাটা নিলেন, তা কিসের জন্য নিয়েছিলেন? চাকরি পাওয়ার জন্য নয়? তাহলে আপনি কোন পর্যায়ে পড়ছেন? শিক্ষিত না অশিক্ষিত?
আমি আপনাকে আবারও বলছি শিক্ষিত মানুষেরা ধর্মের পেছনে ছোটে না। তারা জানে যে যুক্তির বাইরে জগৎ চলে না। মৌলবাদীরা মানুষকে বিশ্বাসের ভিত্তিতে পরিচালিত করার চেষ্টা করে। তাই শিক্ষিত মানুষেরা কখনোই ধর্মীয় ধ্বজাধারীদের পিছনে ছোটে না। এই বোধটা আমাদের থাকাটা খুব জরুরী। আপনারও।
একটা জাতিকে শক্তিশালী হতে গেলে তাকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হয়। তাকে যুক্তিবাদী হতে হয়। বিজ্ঞান মনস্ক হয়ে উঠতে হয়। সমগ্র জাতিকে একসূত্রে বাঁধতে হয়। কোন দেশের জনগণ যদি পরস্পর পরস্পরের উপর দোষারোপ করতে থাকে, একজন মানুষের ভুলকে ধরে সমগ্র সম্প্রদায়কে দোষারোপ করা হয়, তাহলে কীভাবে ঐক্য সম্ভব? আর এটাকে দেখিয়ে যদি কোন মৌলবাদী শক্তি একজন মানুষকে ভুল পথে চালিত করে, তাহলে তার দায়টা কি শুধু তার একার? তার প্রতি আপনার অবিশ্বাস, অসম্মান, ঘৃণা দায়ী নয়? আধুনিক শিক্ষা নিয়েছেন, চাকরি করছেন, নিশ্চয়ই শিক্ষিত। তাহলে আমার যুক্তিটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন? হ্যাঁ, যদি প্রকৃত শিক্ষিত হন, নিশ্চয়ই বুঝবেন। আর যদি না বোঝেন তাহলে পরোক্ষে আপনি একজন মানুষকে বিপথগামী করার চেষ্টা করছেন। এবং আপনিও একজন অশিক্ষিত মানুষ, মৌলবাদী মানুষ। প্লিজ এই ধরনের মতামত প্রদান থেকে বিরত থাকুন। আমি, আপনি শিক্ষিত কিনা তা প্রমাণ করার দায় আমাদের নিজেদের।
যুক্তিবাদী যদি না হয় কেউ, তার যে কোন মুহূর্তে মৌলবাদী হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। যেমন আপনি লেখাপড়া জানা সত্ত্বেও এমন কথা বললেন, যার দ্বারা প্রমাণ হলো, আপনিও একধরনের মৌলবাদী, যুক্তিবাদী নয়।
কোথাকার কোন কাগজে বেরোলো ইসলামিক স্টেট মুসলমানদের বলেছে যে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে দাও, আর আপনি ধরে নিলেন এই ভারতবর্ষের সব মুসলমান সেই কথা শুনে নাচবে? কোন যুক্তিতে? যারা এমন ভাবে তাদের শিক্ষা এবং বুদ্ধি সম্পর্কে সন্দেহ থেকেই যায়। আর যদি সে দাবী করে যে, না সন্দেহ করার কিছু নেই, আমি যা ভাবছি বা বলছি তা জেনে বুঝে বুঝেই বলছি, তবে তিনিই এক নম্বরের মৌলবাদী।
ইসলামিক এস্টেট ভারতীয় মুসলমানদের কি কাজে লাগবে? ভারতীয় মুসলমানদের কি আপনি বোকা...... ভাবেন।
লেখাপড়া শিখলেই কেউ শিক্ষিত হয়ে যায় না অমিতাভ বাবু। আর এটা ধর্ম নিরপেক্ষ নয় (শব্দটা 'ধর্মনিরপেক্ষ' নয়), এটা সব ধর্মের মানুষের মধ্যেই আছে। বর্তমান ভারতের জন্য মুসলিম মৌলবাদের চেয়ে হিন্দু মৌলবাদ বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। এই দুটো মৌলবাদই ভারতীয় জাতিসত্তার পক্ষে ক্ষতিকারক। ক্ষমতার দিক থেকে এদের কমবেশি হতে পারে, কিন্তু সংগঠক হিসেবে দুটি ভয়ঙ্কর ক্ষতিকারক। একে বাড়তে দিলে কেউ মুক্তি পাবনা। আপনিও না, আমিও না। এদের একটাকে তোল্লা দিলে আর একটা বেড়ে যাবে স্বাভাবিক নিয়মে, এটা বোঝার চেষ্টা করুন। তাই মুসলমান বা হিন্দু সম্প্রদায়কে নয়, মৌলবাদকে ঘৃণা করতে শিখুন।
সবশেষে বলি, বিভেদের চেষ্টা পৃথিবীর সব ধর্ম সম্প্রদায়ের ধান্দাবাজ লোকেরা করে থাকে। কখনও কখনও রাষ্ট্রশক্তি, রাজনৈতিক দল এবং মিডিয়াগুলো তাদের তোল্লা দেয়। এক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান বলে ভাগ করার কোন যুক্তি দেখিনা। তাই আমি যখন মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে কথা বলি তখন সবার কথাই একসঙ্গে বলি। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, অধিকাংশ মানুষ সেটা করেন না। তিনি যে ধর্মের মানুষ সেটাকে উহ্য রাখেন আর বিপরীত ধর্মের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন। এটাই হচ্ছে আমাদের সমস্যা। মানবজাতির একটা বড় অংশের সমস্যা। এখান থেকে সাধারণ মানুষ যেদিন বেরোতে পারবে, সেদিনই 'এ পৃথিবী আবার শান্ত হবে'।
ভালো থাকুন। আর মনে রাখুন, নিজেকে ভালো থাকতে গেলে অপরকে ভালো থাকতে সাহায্য করতে হয়। এটাই মানব সভ্যতার ভালো থাকার মূল চাবিকাঠি।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন