Goutam Ray আমি কীভাবে বঙ্কিমচন্দ্রকে অপমান করলাম, যদি একটু বুঝিয়ে বলেন কৃতজ্ঞ থাকব।
যদি Shubhra Kanti Bhattacharyya এর মতামতের সঙ্গে সহমত পোষণ করাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, তবে কিছু কথা বলার থাকে।
আসলে ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে যতটুকু পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছি তাতে বঙ্কিমচন্দ্রকে বুঝতে আমার ভুল হওয়ার কথা নয়।
আসলে উপনিবেশিক শাসনকালে পাশ্চাত্য শিক্ষার সংস্পর্শে যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে একদিকে যেমন ইউরোপীয় যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ, আইনের শাসন ইত্যাদি ধারণাগুলো প্রবেশ করেছিল, তেমনি ইউরোপীয়দের বিশেষ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অন্যায় ভাবে বাংলার রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করা এবং তাকে ন্যায্যতা দেয়ার জন্য হিন্দু মুসলিমের মধ্যে ফাটল ধরানোর যে অপচেষ্টা তারা করেছিল তারও প্রভাব তাদের মধ্যে প্রবেশ করেছিল। রাজনৈতিক ক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এই চক্রান্তের সঙ্গে বাংলাদেশের বণিক সম্প্রদায়ের স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী (জগৎ শেঠ, রাজা রাজবল্লভ প্রমূখ) সাম্প্রদায়িক চেতনার জন্ম দিয়েছিল তা মিলেমিশে এক ভয়ঙ্কর জাতিবিদ্বেষী চেতনার জন্ম হয়। শুধু বঙ্কিমচন্দ্র নয়, ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর থেকে শুরু করে প্রায় প্রত্যেক মানুষের মধ্যে তার প্রভাব পড়েছিল। একমাত্র ব্যতিক্রম, এখনো পর্যন্ত যতটা জানতে পেরেছি, তা রবীন্দ্রনাথের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়।
স্বাভাবিকভাবেই বঙ্কিমচন্দ্র সহ সমসাময়িক অন্যান্য মনীষীদের মধ্যে পরস্পর বিপরীত চিন্তা চেতনা এক ধরনের অন্তর্দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে। এই দ্বন্দ্বের কারণেই তাদের লেখনীর মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন স্বদেশপ্রেমের জোয়ার বয়েছে, জাতিগত সংহতির কথা উঠে এসেছে, ঠিক তেমনি ভারতীয় সমাজের ভিত্তিভূমিতে যে জাতিগত বৈষম্য ছিল, তাও তাদের চেতনাকে কখনো কখনো আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। এ কারণেই তাঁদের লেখায় প্রায়ই সেই পরস্পর বিরোধী ভাবনার অবতারণা ঘটেছে।
আর এজন্যেই বঙ্কিমচন্দ্রের অনেক লেখায় সাম্প্রদায়িক ভাবনা ডানা মেলে ছিল। এই সত্যকে আপনি লুকাবেন কী করে? আমি জানি যুগের একটা সীমাবদ্ধতা থাকে। সীমাবদ্ধতার কারণে এই বৈপরীত্যের জন্ম হয়। কিন্তু সেটাকে ঢেকে রাখার কি কোন যুক্তি থাকে? সত্যকে চেপে যাওয়া এক ধরনের অপরাধ। যার মধ্যে যতটুকু গুন আছে, সেটা বলার সাথে সাথে তার সীমাবদ্ধতাগুলো বলাটাও জরুরী। তবেই তার যথাযথ মূল্যায়ন হয়। আর মূল্যায়ন যথাযথ না হলে সমস্যা তো কমেনা বরং বাড়ে। আমার মনে হয় বঙ্কিমচন্দ্রের ত্রুটিগুলোকে বা সীমাবদ্ধতাগুলো আঁড়াল করার কারণেই স্বাধীনতা সংগ্রামের একটা পর্বে বঙ্কিমচন্দ্র বিকৃত ভাবে ব্যবহৃত হয়েছেন। ফলে যে স্বাধীনতা সংগ্রাম হিন্দু মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম ছিল তা আস্তে আস্তে দ্বিজাতি তত্ত্বের জন্ম দিয়েছে। এক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্রের বক্তব্যকে যারা বিকৃত করেছিলেন তারাই বেশি করে দায়ি। ''গড' বলি, 'আল্লা' বলি, 'ব্রহ্ম' বলি, সেই এক জগন্নাথ বিষ্ণুকেই ডাকি। সর্বভূতের অন্তরাত্মা স্বরূপ জ্ঞান ও আনন্দময় চৈতন্যকে যে জানিয়েছে, সর্বভূতে যাহার আত্মজ্ঞান আছে, যে অভেদী, অথবা সেইরূপ জ্ঞান ও চিত্তের অবস্থা প্রাপ্তিতে যাহার যত্ন আছে, সেই বৈষ্ণব ও সেই হিন্দু। তদ্ভিন্ন যে কেবল লোকের দ্বেষ করে, লোকের অনিষ্ট করে, পরের সঙ্গে বিবাদ করে, লোকের কেবল জাতি মারিতেই ব্যস্ত, তাহার গলায় গোচছা করা পৈতা, কপালে কপালজোড়া ফোঁটা, মাথায় টিকি এবং গায়ে নামাবলি, মুখে হরিনাম থাকিলেও তাহাকে হিন্দু বলিব না।" আচ্ছা বলুন তো বঙ্কিমচন্দ্রের এই কথাগুলো কোনদিন আপনি কোন হিন্দুত্ববাদী সংগঠন এর কাছ থেকে শুনেছেন। শোনেন নি। তারা বঙ্কিমচন্দ্রের সেটুকুই ব্যবহার করেছেন, যেটুকু দিয়ে হিন্দুত্ববাদকে উসকে দেয়া যায়। এ দায় কার? এ দায় তাদের যারা বঙ্কিমচন্দ্রকে সাম্প্রদায়িক স্বার্থে অসম্পূর্ণ ভাবে ব্যবহার করেছেন।
এটাকেই শুভ্র বাবু গোড়ায় গলদ বলে উল্লেখ করেছেন বলে আমার ধারণা। আর তাই তার সঙ্গে আমি সহমত পোষণ করেছি। উনি যে কথাগুলো বলেছেন তা তো মিথ্যা নয়, তাহলে কীভাবে আমি তাঁর মতামতকে অস্বীকার করব?
আমার মনে হয় আমাদের মনে রাখা উচিত কোন ব্যক্তির সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করা মানে তাঁকে অপমান করা নয়। সীমাবদ্ধতা থাকা স্বাভাবিক যেমন, কেমন সেই সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করাও স্বাভাবিক। এটা না করলেই সংকট বাড়ে।
আর বিজেপি কথা বলছেন, ওদের জন্য সংগঠিত আইটি সেল আছে। মিথ্যা আর বিকৃত ভাবে তথ্য উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে ওরা ক্ষমতায় এসেছে এবং আসার চেষ্টা করছে। এটাকে আটকানোর জন্য সত্যকে ঢেকে রাখার কোনো প্রয়োজন আছে? আমার মতে, প্রয়োজন আসল সত্য মানুষের সামনে প্রকাশ করে মানুষের ভাবনাকে যুক্তি সম্মত এবং পরিশীলিত করে তোলা। এটাই খুব জরুরী।
যাই হোক ভালো থাকুন, ভালো ভাবনার সাথে থাকুন, এবং আপনার চিন্তা-চেতনাকে বিনা দ্বিধায় উপস্থাপন করে আমাদের আলোচনাকে এগিয়ে নিয়ে চলুন।
শুভ রাত্রি।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন